logo
news image

জিআই পণ্য কাঁচাগোল্লার স্বাদ ও ঘ্রাণ অক্ষুন্ন থাকবে

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
প্রায় আড়াই শ বছর ধরে একই স্বাদ ও ঘ্রাণ নিয়ে টিকে থাকা নাটোরের ঐতিহ্য কাঁচাগোল্লাকে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট দেশের ১৭তম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত আকারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছিল। তবে এ নিয়ে নাটোরের মানুষের করণীয় কিছুই ছিল না। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের প্রসিদ্ধ একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাটোরে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রে গোলাকার কাঁচাগোল্লা বিক্রি শুরু করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। নাটোরের সুধীমহল থেকে কাঁচাগোল্লা বিকৃত করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করা হয়। এ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচাগোল্লার জিআই সনদ নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) কাঁচাগোল্লাকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২৩ সালের ৭ জুলাই একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়-পানি, দুধ ও তৈরির বিশেষ প্রক্রিয়া ছাড়া নাটোরের কাঁচাগোল্লার আদি বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা যায় না। নাটোরের সীমানা পেরিয়ে এর সুখ্যাতি সারা দেশে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। এরপর একে একে ঢাকাই মসলিন, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, নেত্রকোনার বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বাংলাদেশি কালিজিরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, ইলিশ, বাগদা চিংড়িসহ ১৭টি পণ্য জিআই সনদ পায়।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে ডিপিডিটি এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
কাঁচাগোল্লার জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নাটোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমে ডিপিডিটিতে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সে প্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি অনুমোদন করা হয়।
ইতিহাস:
নাটোর নামটি উচ্চারণের সাথে সাথে এসে যায় আরেকটি নাম এবং তা হলো-‘কাঁচাগোল্লা’। নাটোরের সুবিখ্যাত এই মিষ্টি কিন্তু মোটেই কাঁচা নয় আর এর আকারটিও গোল নয়। তবু এর নাম ‘কাঁচাগোল্লা’।
মিষ্টিপ্রিয়দের রসনা মেটাতে নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লার পরিচিতি এখন বাংলাদেশের বাইরেও সমান। ১৭ শতকে রাণী ভবানীর আমল থেকে নাটোরে কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে আসছে। কাঁচাগোল্লার সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই। তবে একটি প্রচলিত কিংবদন্তী রয়েছে, সেটা হলো- রাণী ভবানীর রাজত্বের গোড়ার দিকের কথা। একদিন মিষ্টি তৈরির একটি বড় দোকানে মধ্যরাতে ঝাঁপি বন্ধ করবার সময় কয়েক মণ দুধ নিয়ে এসে হাজির হলো এক মাঝ বয়সী গোয়ালা। দোকানের মালিক মধুসূদন পাল সেই দুধ নিয়ে বিব্রত হলেন। শেষ সময়ে আনা এই দুধ নিয়ে কি করবেন ভেবে পেলেন না। শেষ তক্ কর্মচারীদের পরামর্শে জ্বাল না দিয়ে দুধ কাঁচা রেখে তিনি বাড়ি ফিরলেন। কথা ছিলো, পরদিন দোকানে এসে ইচ্ছেমত ছানা তৈরি করে মিষ্টি বানানো হবে। কিন্তু সকালে এসে পাল মশাই দু’চোখ কপালে তুলে দেখেন-সবটা দুধ নষ্ট হয়ে গেছে। রেখে মেগে কর্মচারীদের সেই দুধ জ্বাল দেওয়ার আদেশ দিলেন তিনি। দুধ ঘন হলে তাতে চিনি মিশিয়ে খাবার উপযোগী করে তোলা হলো। স্বাদ বাড়ানোর জন্যে মশলাও দেওয়া হলো। চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করে সেই মিষ্টি তারা নিজেরা খেলেন এবং গ্রাহকদের ডেকে এনে খাওয়ালেন। এই নতুন মিষ্টি কেন জানি তখন অনেকের ভালো লেগে গেলো এবং এভাবেই হলো কাঁচাগোল্লার আবির্ভাব ।
১৭৫৭ সালের দিকে কাঁচাগোল্লার কদর বেড়ে যায়। বিয়ে-শাদী, ঘরোয়া জলসা, আনন্দ উৎসব ইত্যাদিতে এর বায়না আসতে থাকে একের পর এক। পাল মশাই আর সামাল দিতে পারলেন না। দোকানের পুরানো ময়রাদের কয়েকজন মালিকের কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই আলাদা দোকান দিয়ে বসলো, কারণ কাঁচাগোল্লা তৈরির ফর্মুলা তখন তাদের জানা হয়ে গেছে। এমনিভাবে নাটোর শহরের মিষ্টির দোকানগুলোতে কাঁচাগোল্লার ব্যবসা ফেঁপে ওঠে। স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় মিষ্টি কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। নাটোরের স্থানীয় জনগণ ছাড়াও বাইরের লোকজনও বায়না দিয়ে কাঁচাগোল্লা নিয়ে যেতে লাগলো।
ইদানীংকালে বেশ যত্নসহকারে তৈরি করা হয় কাঁচাগোল্লা। চিনির সাথে ছানা পরিমাণ মত পানিতে দিয়ে চুলায় তুলে ধীরে ধীরে তাপ দিতে হয়। চুলায় জ্বাল দেওয়ার জন্যে অন্য যে কোনো ধরনের পাত্রের চেয়ে কড়াই ব্যবহার করা শ্রেয়। চিনি গলে কড়াইতে যে গাদ সৃষ্টি করে তা চামচ দিয়ে ফেলে তবেই ঐ চিনির গরম রসে ছানা মিশিয়ে দিতে হয়। ঘন হয়ে ছানা দানাদার হয়ে গেলে চুলা থেকে নামানোর আগে দিতে হয় ছোট এলাচের গুঁড়া। ঠান্ডা হবার পর আরও বেশি স্বাদের হয় কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার সৃষ্টি নাটোরে এবং নাটোরের ময়রারা এ কাজে পটু। আর তাই এই মিষ্টির সাথে নাটোরের নাম জড়িয়ে গেছে চিরকালীনভাবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে মোটামুটি এক শতাব্দী সময়কালে নাটোরে যে সব মিষ্টির দোকান কাঁচাগোল্লার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলো, সেগুলোর মধ্যে বনমালী দাস, পূর্ণচন্দ্র পাল, প্রাণহরি পাল, মধুসূদন পাল ও ঘোষ কোম্পানীর দোকান ছিলো সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সে সময় কাঁচাগোল্লার দক্ষ কারিগরদের মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন গোবিন্দ পাল, হরেন্দি দাস, অন্নদা পাল, দেমন্ত সরকার ও পাঁচু গোপাল দেব প্রমুখ। দূর পাল্লার যাত্রায় চলন্ত বাস, ট্রেন অথবা স্টীমারে অনেক সময় নাটোরের কাঁচাগোল্লা বিক্রি হতে দেখা যায়, যা হয়তো মানসম্মত নয়। বায়না দিয়ে দোকান থেকে যা বিক্রি হয় তার মান মোটামুটি বজায় থাকে। ১৯২০-১৯২৫ সালের দিকে এক সের সুস্বাদু কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয়েছে মাত্র দেড় থেকে দুই টাকা দরে। ১৯৪০ সালের দিকে এই দর বাড়তে থাকে আনুপাতিকভাবে। ২০০৯ সালে সময়ে দোকানে নাটোরের সুবিখ্যাত কাঁচাগোল্লার দর প্রতি কেজি একশ টাকার উপরে। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা। তবে একথা মানতেই হবে, মিষ্টিপ্রেমীদের রসনা মেটাতে নাটোরের কাঁচাগোল্লা এক অপূর্ব সৃষ্টি। নাটোরের বাইরের লোকজন এই মিষ্টি খেয়ে অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন, ‘কাঁচাগোল্লা কেনো গোল নয়?’
নাটোরের কাঁচাগোল্লার কারিগররা কিন্তু এখনও এটিকে গোল না করে তার আদি বৈশিষ্ট্যটি ধরে রেখেছেন। (সূত্র: নাটোরের বনলতা সেন, হাসানুর রহমান, বাড পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা-২৪-২৫)।
বর্তমানে কাঁচাগোল্লার জন্য প্রসিদ্ধ নাটোর শহরের আলাইপুরের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার, লালবাজারের দ্বারিক মিষ্টান্ন ভান্ডার, জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার, কানাইখালির নবরূপ মিষ্টান্ন ভান্ডার ও চকরামপুরের ইসলামিয়া (পচুর) হোটেল। কারিগরদের মধ্যে মিঠুন চক্রবর্তী, বাপ্পি তরফদার, অরুণ পাল, উৎপল পান্ডে, বিপ্লব পাল ও বিপুল তরফদার উল্লেখযোগ্য।
চাহিদা এবং দুধ-চিনি ও মসলার দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কাঁচাগোল্লায় ভেজাল মেশাতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে নাটোরের কাঁচাগোল্লা বলে হাকডাক দিয়ে বাসে-ট্রেনে ফেরি করে বিক্রি করা হচ্ছে নকল কাঁচাগোল্লা। নিম্নমানের এসব কাঁচাগোল্লা খেয়ে মিষ্টিপ্রেমীদের কাছে কাঁচাগোল্লা সম্পর্কে ভুল ধারণা জন্মাচ্ছে, এর সুখ্যাতিও নষ্ট হচ্ছে।
হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী কাঁচাগোল্লার গুণগত মান ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন জানিয়ে জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক প্রভাত পাল বলেন, কাঁচাগোল্লা তৈরিতে ছানা, চিনি ও মসলার দরকার হয়। সবকিছুর দামই বহু গুণ বেড়ে গেছে। মান ঠিক রেখে কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে হলে প্রতি কেজির দাম পড়বে ৬০০ টাকার ওপরে, যা সব ক্রেতার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাই অনেকেই ভেজাল ছানা দিয়ে নিম্নমানের কাঁচাগোল্লা তৈরি করছেন।
মতামত:
চার পুরুষ ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নাটোরের ঐতিহ্যবাহী জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান স্বত্বাধিকারী প্রভাত কুমার পাল বলেন, জিআই স্বীকৃতির আবেদন অনেক আগেই করা দরকার ছিল। বিভিন্ন ধরনের মানহীন মিষ্টি কাঁচাগোল্লা নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়। এতে নাটোরের সুনাম নষ্ট হয়। এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিকৃত আকারে উৎপাদন বন্ধ হবে। দেশের মানুষ আসল কাঁচাগোল্লা চিনে কিনতে পারবেন।
নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতিতে ভূমিকা রাখতে পেরে আনন্দিত।
নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা বলেন, নাটোরের ঐতিহ্য ধরে রেখে উৎপাদকেরা কাঁচাগোল্লা প্রস্তুত করেন। মানহীন ও বিকৃত আকারে কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধে জেলা প্রশাসন ভূমিকা রাখবে।

সাম্প্রতিক মন্তব্য