logo
news image

নবেসুমি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
অর্ধশতাধিক মুক্তিকামী মানুষের আর্তনাদ। শহীদের রক্তে রঞ্জিত একটি পুকুর। স্বাধীনতার ইতিহাসে সারা দেশে একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তী। নাম তার ‘শহীদ সাগর’।
শুক্রবার (৫ মে ২০২২) শহীদদের স্মরণে ফাতেহা পাঠ, পুস্পস্তবক অর্পন, শহীদ পরিবারের সংবর্ধনা, আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, কাঙালী ভোজ ও খতমে কোরআনের আয়োজন হয়।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল। এ সময় মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল আজম, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারী, সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
নাটোরের লালপুরের নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের ভেতরে একটি পুকুর। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৫ মে এই পুকুরের সিঁড়িতে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে তৎকালীন প্রশাসক লে. এম এ আজিমসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার পর পুকুরটির নামকরণ হয় ‘শহীদ সাগর’।
একাত্তরে সিঁড়ির যেসব জায়গায় বুলেট বিদ্ধ মানুষ লুটিয়ে পড়েছিল, সেসব জায়গায় লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সিঁড়িতে পা রাখলে এখনো শিউরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভয়ে গা ছমছম করে। অনেক বছর পরেও এই পুকুরের পানি রক্তের মতোই ছিল ‘লাল’। এই গণহত্যায় জড়িত ছিলেন, মেজর শেরওয়ানী, মেজর উইলিয়াম ও ক্যাপ্টেন মোখতার।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় আমার স্বামী, স্মৃতি: ১৯৭১-এ লে. এম এ আজিমের স্ত্রী শামসুন্নাহার আজিম লিখেছেন, ‘নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের যে পুকুর পাড়ে ১৯৭১ সালের ৫ মে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আত্মাহুতি দিলেন, সেই পুকুরের বর্তমান নাম ‘শহীদ সাগর’ এবং এই পুকুর পাড়েই আমার সমস্ত স্মৃতি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই শতাধিক শহীদের মধ্যে রয়েছেন আমার স্বামী লেফটেন্যান্ট মো. আনোয়ারুল আজিম।...
‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উদ্যত বন্দুকের সামনে তিনি অকুতোভয়ে জামার বোতাম খুলে বুক পেতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, “আমাকে গুলি না করে আমার একটা লোককেও গুলি করা যাবে না।”...
‘সকালে আজিম সাহেব মিলের অন্যান্য কর্মচারীসহ পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন।...আমার স্বামী মিল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মিলিটারি মিলে লুটপাট শুরু করে দেয়।...আজিম সাহেব গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর একজন মিলিটারি তাঁর অফিসে গিয়ে গেস্টহাউসে অফিসার সালাম জানিয়েছে বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাঁকে পথের পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়।...নর্থবেঙ্গল সুগার মিল ছিল নাটোর জোনের মধ্যে এবং সেখানকার ইনচার্জ মেজর সেরওয়ানী আমরা যে গ্রামে পালিয়ে ছিলাম সেখান থেকে আমার স্বামী ও মিলের কেমিস্ট মি. শওকতকে ধরে নিয়ে মিল চালু করার নির্দেশ দেয়। মিলের লোকের নিরাপত্তার জন্য মেজর কোরআন ছুঁয়ে শপথ করে যদি মিলে কোনো লোকের ক্ষতি হয় তাহলে সে তার ব্যাজ খুলে ফেলবে।’
শহীদ সাগরের লাশের স্তূপ থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে যান খন্দকার জালাল আহাম্মেদ। তিনি বলেন, ওই দিন বেলা ১১টার দিকে মিলের পাওয়ার হাউসে ডিউটি করছিলেন। তৎকালীন প্রশাসক লে. এম এ আজিমসহ সবাইকে পুকুরের সিঁড়িতে সারি করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। নির্দেশ পাওয়া মাত্র বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ। গুলিবিদ্ধ হয়ে লাশের স্তূপে চাপা পড়ে জ্ঞান হারান। চেতনা ফিরে দেখেন, মেহমান আলী নামে এক কর্মচারী তাঁর মুখটা পানি থেকে তুলে সিঁড়ির ওপরে রেখে পালিয়ে বাঁচেন। অর্ধমৃত শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছে নিশ্চিত মৃত্যু হতে জীবন ফিরে পান।
১৯৭৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গোপালপুর রেল স্টেশনের নামকরণ হয় ‘আজিমনগর স্টেশন’। ১৯৭৩ সালের ৫ মে শহীদ লে. এম এ আজিমের স্ত্রী শামসুন্নাহার আজিম উদ্বোধন করেন ‘শহীদ সাগর স্মৃতিসৌধ’। পাশেই ২০০০ সালের ৫ মে উদ্বোধন করা হয় ‘শহীদ স্মৃতি জাদুঘর’। শহীদদের ব্যবহৃত পোশাকসহ অন্য জিনিসপত্র এখানে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ উন্মোচন করেছে শহীদ আজিমের ছবিসহ স্মারক ডাকটিকিট। উদ্বোধনকালে পরিদর্শন বইয়ে শামসুন্নাহার আজিম লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার জন্য নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের যে অবদান, বুকচিরে এক পুকুর রক্তদানের স্বীকৃতি এই জাদুঘরের মাধ্যমে দেওয়া হলো।’ বাংলাদেশের চিনিকল সমুহের শহীদ দিবস হিসেবে ২০০০ সাল থেকে দিনটি পালিত হয়।
এই গণহত্যায় শহীদরা হলেন, লে. (অব.)  আনোয়ারুল আজিম (প্রশাসক), সহিদুল্লাহ, গোলজার হোসেন তালুকদার, সাইফুদ্দিন আহমদ, আবুল হোসেন, আবদুর রউফ, খন্দকার আব্দুল মান্নান ভূইয়া, গোলাম কিবরিয়া, মো. নূরুল হক, আজহার আলী, মকবুল হোসেন, আবুল বাসার খান, মনসুর রহমান, সাজেদুর রহমান, খন্দকার ইসমাইল হোসেন, হাবিবুর রহমান, মোসাদ্দারুল হক, মোকসেদুল আলম, আব্দুর রহমান আমিন, মোহাম্মদ আলী-১, মোহাম্মদ আলী-২, মোজাম্মেল হক, আব্দুল মান্নান তালুকদার, ফিরোজ মিয়া, আকতার উদ্দিন, সোহরাব আলী, আনোয়ারুল ইসলাম, পরেশ উল্লাহ, আ. মান্নান, কামাল উদ্দিন, আবুল কাসেম, আব্দুর রব, শামসুল হুদা, আব্দুল মজিদ, আবুল কালাম, এস এম নজরুল ইসলাম, আয়েজ উদ্দিন, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল প্রামানিক, মোসলেম উদ্দিন, জহির উদ্দিন, শহীদুল্লাহ ছাড়াও আরো নাম না জানা অনেকে।
গুলিবিদ্ধ লাশের স্তুপে বেঁচে যান, খন্দকার জালাল আহাম্মেদ,  মেহমান আলী, নওসাদ আলী, খোরশেদ আলম, খন্দকার ইমাদ উদ্দিন আহম্মেদ, ইঞ্জিন সরদার, আব্দুল জলিল সিকদার, তোফাজ্জল হোসেন, আজের উদ্দিন মাল প্রমুখ। তাঁদের কেউ এখন বেঁচে নেই।
ওই দিন গোপালপুর বাজারে হত্যাকান্ডে আরও সাতজন শহীদ হন। তাঁদের স্মৃতিতে ২০১৯ সালের ৫ মে গোপালপুর বাজার কড়ই তলায় নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ। তাঁরা হলেন, ডা. শাহাদত হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন, সাজদার রহমান, আবুল হোসেন, আশরাফ আলী, খোদা বকস খলিফা ও কাজি রফিকুল ইসলাম চাঁদ।
একই দিনে লালপুর-গোপালপুর সড়কের শিমুলতলা নামক স্থানে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন ছয়জন। তাঁদের পরিচয় পাওয়া তিনজন হলেন, হাবিবুর রহমান, আনোয়ার হোসেন মনি, ও আতোয়ার হোসেন মিন্টু।

সাম্প্রতিক মন্তব্য