গোলকপুর জমিদারির ইতিহাস আছে নেই জমিদার বাড়ি
মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য, কেল্লা তাজপুর, কেল্লা বোকাইনগর, পাঠান ও মুঘল আমলের সর্দারবাড়ি, মসজিদ, মন্দির, ব্রাহ্মণ পরিবারের ১২টি জমিদারবাড়ি ও শিল্প-সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা। গৌরীপুর সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ আসলেই কৃষ্ণপুর জমিদার বাড়ি ও গোলকপুর জমিদারির কথা চলে আসে।
এই উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশ শাসন তখন গৌরীপুরে ১২ জন জমিদারের বসবাস ছিল। শুধু গৌরীপুর পৌরসভায় (বর্তমান হিসেবে) গৌরীপুর রাজবাড়ির দক্ষিণে কালীপুর জমিদারবাড়ি (বড় তরফ, মধ্যম তরফ, ছোট তরফ ও নয়া তরফ), কৃষ্ণপুর জমিদারবাড়ি, গোলকপুর জমিদার বাড়ি এবং উত্তরে ভালুকা জমিবাড়ির অবস্থান নিয়ে মোট আট জন জমিদার বসবাস করতেন। কৃষ্ণপুর জমিদারবাড়ি ও গোলকপুর জমিদারবাড়িকে ঘিরে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গৌরীপুর সরকারি কলেজ। একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার মতো গৌরীপুর সরকারি কলেজে জায়গা রয়েছে। দুই জমিদারির মাঝখানে বর্তমানে রয়েছে একটি বড় খাল; যা এক সময়ে বালুয়া নদী বা শাখা নদী ছিল। এটি তখন ছিল খরস্রোতা। নদীর উত্তরপাড়ে কৃষ্ণপুর জমিদারবাড়ি এবং দক্ষিণপাড়ে গোলকপুর জমিদারবাড়ি। সে ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা।
কৃষ্ণপুর জমিদারবাড়িতে রয়েছে কলেজের মূল অংশ ও অ্যাকাডেমিক ভবন। কলেজ প্রধান ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়বে বিশাল সুন্দর কারুকার্য খচিত কাছারি বাড়ি ও দরবার হল। তার বিপরীতে রয়েছে দুইটি পুকুর, বাগান এবং পিছনে জমিদার বাড়ির অন্দরমহল। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জমিদার বাড়িটি দেখতে ভীড় জমায় ভ্রমণ পিপাসুরা।
গোলকপুর জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে রয়েছে কলেজের দুটি হোস্টেল, বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ, পুকুর ও ধান ক্ষেত। শুধু নেই জমিদার বাড়িটি। সংস্কার আর সংরক্ষণের অভাবে গোলকপুর জমিদার বাড়িটি মানচিত্র থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে ৪০ থেকে ৫০ বছর আগেই। কতিপয় স্থানীয় লোকেরা সেখান থেকেও টিন, বিম ও ইট খুলে নিয়ে গেছে। অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা এবং নিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান সম্পদ।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জমিদারি সম্পত্তি ( ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ) চার আনা করে চার ভাগে বিভক্তঃ
তরফ করৈ শেলবর্ষ পরগনা (বগুড়া), ছিন্দাবাজু পরগনা (বগুড়া), জাফরশাহী পরগনা (জামালপুর), মোমেনসিং পরগনা (পূর্ব ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ) এই চার পরগনার জমিদার ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বগুড়ার কড়ই রাজবাড়িতে দুই বিয়ে করেছিলেন। আদমদিঘি উপজেলার কড়ই রাজবাড়িতে তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। তারা পৃথক বাড়িতে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর বিষয় সম্পত্তি অবিভক্ত ছিল। জমিদারির শাসন, সংরক্ষণ, তদারকি একযোগে হতো। জমিদারির দাপ্তরিক কাজও একত্রেই হতো। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ এই চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দু’টি তরফ গঠিত হয়েছিল - প্রথম তরফ রায়চৌধুরী হিস্যা ও দ্বিতীয় তরফ চৌধুরী হিস্যা।
তখন দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় অত্যাচারী ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার বা পুতুল নবাবদের বিরুদ্ধে লড়াকু নেতা ফকির মজনু শাহ-এর কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল। ১৭৫৯-৬০ এর মধ্যে ইংরেজ ও পুতুল নবাবদের বিরুদ্ধে লড়াকু নেতা ফকির মজনু শাহ-এর প্রভাবে ও ভয় পেয়ে তরফ রায়চৌধুরী ও তরফ চৌধুরী উভয় দলই আত্মকলহের পরিবর্তে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাতে লাগেন। তারা তখন বগুড়ার আদমদিঘি উপজেলার কড়ই গ্রাম ছেড়ে জাফরশাহী পরগনায় কৃষ্ণপুর গ্রামে এসে (বর্তমান জামালপুর জেলা শহর) প্রথম তরফ রায়চৌধুরীর রাজপরিবার এবং মেলান্দ উপজেলার মালঞ্চ গ্রামে এসে দ্বিতীয় তরফ চৌধুরীর রাজপরিবার বসবাস শুরু করেন।
ঢাকাস্থিত তৎকালীন প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুহাম্মদ রেজা খানের কাছে আবেদন করার পর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ তরফ রায়চৌধুরী হিস্যা ও অপরাংশ তরফ চৌধুরী হিস্যা প্রাপ্ত হলেন। এর মধ্যদিয়ে বহুদিনের আত্নবিরোধ শেষ হয়। প্রযাত কৃষ্ণগোপালের দত্তকপুত্র জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরী জাফরশাহী পরগনা অর্থাৎ জামালপুরের কৃষ্ণপুর হতে (ইংরেজি ১৭৬৫ সাল হতে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত) জমিদারি করে আসছিলেন। ১৭৭০ সালের মহামারী অর্থাৎ বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরর ফলে তিনি জাফরশাহী পরগনা ছেড়ে মোমেনসিং পরগায় এসে গৌরীপুর নাম দিয়ে একটি নতুন শহর বা বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে (১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের পর) প্রথম তরফ রায়চৌধুরী হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ গৌরীপুর রাজবাড়ি ও অপরাংশ রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি সৃষ্টি হয়। একইভাবে দ্বিতীয় তরফ চৌধুরী হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ কালীপুর জমিদারবাড়ি ও অপরাংশ বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদারি সৃষ্টি হয়।
গৌরীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন যুগলকিশোর রায় চৌধুরী, রামগোপালপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন প্রয়াত কৃষ্ণকিশোর রায় চৌধুরীর দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নী দেবী, কালীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী এবং বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন লক্ষীনারায়ণ চৌধুরীর তিন ছেলে।
গোলকপুরে জমিদারি উৎপত্তি ও নামকরণঃ
জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে বোকাইনগর বাসাবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো - ‘লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরি মালঞ্চায় কিছুদিন বাস করিয়া তৎপরে পিতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরির বাসা বাটিতে বাস করিতে লাগিলেন, ঐ গৃহই তাহার পুত্র পৌত্রগণের কল-নিনাদে পরিপূর্ণ হইল। তিনি পিতৃ-বর্তমানেই বিষয় কার্যের ভার গ্রহণ করিয়া দক্ষতার সহিত জমিদারি শাসন সংরক্ষণ করিতে লাগিলেন।.......লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরি ভবানী দেবীর পাণিগ্রহণ করেন। তাহার শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র চৌধুরি নামে তিন পুত্র জন্মে। লক্ষ্মীনারায়ণের বাসাবাড়িতেই দেহত্যাগ হইয়াছিল।’
গোলকপুরে জমিদারি উৎপত্তি ও নামকরণের ইতিবৃত্ত গবেষণা ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী কাজ সম্পন্ন করেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
১৭৭০ সালে জামালপুর সদর হতে দত্তক ভ্রাতুষ্পুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী (হিন্দু জমিদার পরিবারের পরিচয়ে বেড়ে ওঠা নবাব সিরাজের অপর স্ত্রী আলেয়ার গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান) মোমেনসিং পরগনার এজমালি সম্পত্তির গৌরীপুর রাজবাড়িতে চলে আসার আগে লক্ষীনারায়ণ চৌধুরী মেলান্দহের মালঞ্চ রাজবাড়ি ত্যাগ করে গৌরীপুরের বোকাইনগরে অবস্থিত পিতার নির্মিত বাসাবাড়িতে চলে আসেন। পরবর্তীতে এই বাসাবাড়ি হতে আরো তিনটি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া লক্ষীপুর, ভবানীপুর, গোলকপুর, গোবিন্দপুর, গোবিন্দগঞ্জ (মালঞ্চ), শ্যামগঞ্জ, শ্যামপুর (মেলান্দহ), শম্ভুগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জ ইত্যাদি স্থানের নামকরণ লক্ষীনারায়ণের বংশ তালিকা হতে সৃষ্টি। যেমন - লক্ষীনারায়ণের স্ত্রীর নামে ভবানীপুর এবং নাতনীর নামে গোলকপুরের নামকরণ করা হয়েছে। জমিদার রুদ্র চন্দ্র চৌধুরীর তিন পুত্র ও তিন কন্যার জনক ছিলেন। তারা হলেন গোলকমণি, কমলমণি ও কুমারী দেবী। গোলকমণি ও কমলমণি অবিবাহিতা অবস্থাতেই পরলোক গমন করেন। লক্ষীনারায়ণের জীবদ্দশায় গোলকমণি ছিল তার আদরের নাতনী। তাই গোলকমণি থেকে নাম হয় গোলকপুর। গোবিন্দ চন্দ্র চৌধুরীর মাধ্যমে গোলকপুর জমিদারির গড়াপত্তন ও বিস্তৃতি লাভ করে।
লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর পুত্রগণের পৃথক বাসস্থান নির্মাণঃ
লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র তিন ছেলে পিতার সম্পত্তির অধিকারী হয়ে কিছুদিন একত্রে ছিলেন। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। শ্যামচন্দ্র চৌধুরী পৃথকভাবে বাসাবাড়ির কাছেই বাসস্থান তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। গোবিন্দচন্দ্র চেীধুরী বোকাইনগর বাসাবাড়ি হতে দুই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত গোলোকপুর স্থানে বাসস্থান তৈরি করে চলে আসেন। রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী বাসাবাড়িতেই রইলেন। এই সময়ে জমিদারির রাজস্ব সম্বন্ধে নূতন বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তিত হওয়ায় তারা বিপদে পড়ে যান। পরে তারা বিবাদ ভুলে নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য যত্নবান হন।
শ্যামচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্রের জমিদারির সম্পত্তি হারানো এবং পুনঃপ্রাপ্তিঃ
বাংলা ১১৭৯ (ইংরেজি ১৭৭৩) সনে ইংরেজ সরকার ময়মনসিংহ ও জফরসাহী পরগণার জমিদারদের প্রতি রাজস্বের নূতন আইনে বন্দোবস্ত করেন। নবাব মীর কাসিম আলী খাঁর (Kasimali Khan) সময় এই মহলের যে রাজস্ব ধার্য ছিল, তা বর্ধিত হয়। শ্যামচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী ওই বর্ধিত রাজস্ব দিতে অস্বীকার করেন। রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু শ্যামচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র কিছুতেই রাজস্ব বৃদ্ধির প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তাদের এই অবাধ্যতার কারণে মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগনার চার আনা অংশ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ভিকন ঠাকুর নামক এক ব্যক্তি ইংরেজ সরকারের নির্ধারিত বর্ধিত রাজস্ব প্রদানে প্রতিশ্রুত হয়ে জমিদারি গ্রহণ করেন।
জমিদারি ভিকন ঠাকুরের পুত্রের নামে পাঁচ বৎসরের মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। ফলে তাদের কাছ থেকে জমিদারি চলে যায়। তখন শ্যামচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্রের চেতনা জন্মে এবং সরকারের কাছে জমিদারি ফিরে পেতে আবেদন করেন। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে বর্ধিত হারে রাজস্ব দিতে স্বীকার করায় তাদেরকে পৈতৃক জমিদারি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারা বাংলা ১১৮৭ (ইংরেজি ১৭৮১) সালে শেক্সপিয়ার সাহেবের থেকে কিছু রাজস্ব কমিয়ে নেন। কিন্তু পরের বছর জন শোর সাহেবের সময় পুনরায় রাজস্ব বাড়ানো হয়। এই ঘটনায় তাদের ক্ষতি, মনোকষ্ট ও উদ্বেগের সীমা ছিল না। তবে ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে, সে সময়ে ইংরেজ সরকারের অবাধ্যতা থাকা জমিদারদের পক্ষে খুবই কঠিন ছিল।
গোলকপুর রাজবাড়ির রানী রাধামণি দেবীঃ
গোবিন্দচন্দ্র অল্পদিন পরেই বাংলা ১১৯০ (ইংরেজি ১৭৮৪) সালে পরলোক গমন করেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন, এইজন্য তার অংশের সমস্ত সম্পত্তি তার স্ত্রী রাধামণি দেবীর অধিকারে আসে। রাধামণি দেবী কোনো দত্তক গ্রহণ করেননি। এমতাবস্থায় ইংরেজি ১৮২২ সালে তিনিও পরলোক গমন করেন। রাধামণি দেবীর জীবিতাবস্থায় শম্ভু চন্দ্র চৌধুরীর পিতা শ্যামচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছিল। ফলে রাধামণি দেবীর মৃত্যুর পর হিন্দু আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে রুদ্রচন্দ্র চৌধুরীই তার সম্পত্তির অধিকারী হন।
প্রয়াত শ্যামচন্দ্রের পুত্র শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী তার পিতার অধিকার নিয়ে বিশেষ প্রতিবাদ করেন এবং রাধামণি দেবীর বর্জিত সম্পত্তির অর্ধাংশের জন্য রাজদ্বারে অভিযোগ করেন। এই সূত্রে উভয় পক্ষের অনেক অর্থ ব্যয় হয়। অনেকদিন পর্যন্ত এই মোকদ্দমা চলে। অবশেষে এই মোকদ্দমা রুদ্রচন্দ্র চৌধুরীর অনুকূলে নিষ্পত্তি হয় এবং তিনিই রাধামণি দেবীর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। আগে রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী ১ আনা ৬ গণ্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্তি অংশের অধিকারী ছিলেন। এই মোকদ্দমার জয়লাভের পর তিনি জমিদারির মোট ২ আনা ১৩ গণ্ডা ১ কড়া ১ ক্রান্তি অংশের মালিক হন।
বোকাইনগর বাসাবাড়ির নয়া তরফ জমিদার শম্ভুচন্দ্ৰ চৌধুরী :
শ্যামচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার একমাত্র উপযুক্ত বংশধর শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তিনি অতি ধৈর্যশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তার অমায়িক ব্যবহারে, ন্যায় বিচারে, সুশাসনে প্রজাদের সুখশান্তির সহিত জমিদারিরও বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। তিনি ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে তার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারের নাম শম্ভুগঞ্জ। বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত একটি শহরাঞ্চল। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজারের সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শম্ভুগঞ্জ বাজার সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো –‘তিনি নিজ নামে একটি বৃহৎ বাজার স্থাপনা করিয়া সাধারণের প্রভূত উপকার সাধন করিয়াছেন। অদ্যাপি শম্ভুগঞ্জ নামক প্রসিদ্ধ বাজার তাহার কীর্তির পরিচয় দিতেছে।’
শম্ভুচন্দ্র প্রথমতঃ অলকমণি দেবীরকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে অমরনাথ রায়ের কন্যা মঙ্গলা গৌরীদেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে ঈশানচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র ও হরিশ্চন্দ্র নামে তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশানচন্দ্র অবিবাহিত অবস্থায় পিতা মাতার হৃদয় শূন্য করে পরলোক গমন করেন। মধ্যম পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীকে আগেই গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রয়াত হরকিশোর রায় চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী ভাগীরথী দেবী দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন এবং তার নাম রাখেন গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার হিসেবে আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী। এই আনন্দ কিশোরের আগের নামেই ঈশ্বরগঞ্জ নামক একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। কনিষ্ঠ পুত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী পিতামাতার স্নেহ যত্নে লালিত হয়ে ও পিতৃগুণে ভূষিত হয়ে জমিদারির বংশোজ্জ্বল করেন। শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী বাংলা ১২৬০ (ইংরেজি ১৮৫৪) সালে বৃন্দাবন ধামে পরলোক গমন করেন।
রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী ঃ
শম্ভুচন্দ্র চৌধুরী মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠ পুত্র হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন। তিনি বাংলা ১২২৬ (ইংরেজি ১৮২০) সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কাছে জমিদারি-কর্ম শিক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি বিজ্ঞান-চর্চায় বিশেষ আসক্ত ছিলেন। তিনি গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরীর ছোট ভাই।
রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী বাসাবাড়ি ত্যাগ করে গোলোকপুরে আগমনঃ
রাজা হরিশ্চন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্রের স্ত্রী রাধামণি দেবীর (ইংরেজি ১৮২২ সালে) মৃত্যুর পর বাংলা ১২৬০ (ইংরেজি ১৮৫৪) সাল হতে গোলকপুরে বাস করতে শুরু করেন। পূর্বে গোলকপুরের বাড়ির অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না; কিন্তু তিনি বাসাবাড়ি ত্যাগ করে অল্পকাল মধ্যেই গোলকপুরের বাসভবন অপূর্ব রূপ ধারণ করেন। লেখক ও জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – "তিনি সাধারণত বিলাসী ও আড়ম্বর প্রিয় ছিলেন, অধিকাংশ সময়ই ঢাকা, কলিকাতা প্রভৃতি স্থানে বাহ্যিক আড়ম্বরের সহিত বাস করিতেন। ঐ সকল স্থানে তাহার বৃহৎ বৃহৎ বাটি ক্রীত ও নির্মিত হইয়াছিল। পরের বাটিতে বাস করা তাহার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ছিল। তাহার প্রত্যেক গৃহ বহুমূল্য দ্রব্যাদি দ্বারা সজ্জিত হইয়াছিল। হস্তী, অশ্ব, শকট প্রভৃতিতে তাহার ধনগৌরব প্রতিভাত হইত।"
গোলকপুরে রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর আমোদ-প্রমোদঃ
রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর সময়ে গোলোকপুরে আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত থাকতো। ঝুলনযাত্রা বা লীলা বর্ষার লীলা ও জন্মাষ্টমী পূজা উপলক্ষে মহাসমারোহে নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও ভুরিভোজ হতো। তিনি সঙ্গীত বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বেহালায় তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, "আইনউদ্দীন ও কজরুদ্দিন নামক দেশ প্রসিদ্ধ কালোয়াতদ্বয় তাহার নিকট নিযুক্ত ছিল। সঙ্গীত চর্চায় তাহার বার্ষিক প্রভূত অর্থ ব্যয় হইত।" তিনি বিখ্যাত কালোয়াত বা (সঙ্গীতের) ওস্তাদ গীত-বাদ্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর অবদানঃ
রাজা হরিশ্চন্দ্র বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বহু অর্থ দান করে ‘দানবীর’ খ্যাতি লাভ করেন। তিনি শিল্প-বিদ্যা শিক্ষার জন্য এককালীন ৪৫ হাজার টাকা দান করে সরকারের বিশেষ ধন্যবাদ পেয়েছিলেন। কলকাতা সিটি কলেজ প্রতিষ্টার সময় পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ফান্ড ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মেধাবী ছাত্রদের জন্য তিনি দুই হাজার টাকা দান করেন। ওই ফান্ড হতে প্রতিবছর বিএ পরীক্ষায় অঙ্কশাস্ত্রে যিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন, তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়ে থাকে।
আসামের একটি এলাকা কামাখ্যায় সিঁড়ি নির্মাণ ও রাজা উপাধি লাভ ঃ
ভারতের আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলার কামাখ্যায় অবস্থিত ‘কামাখ্যা-দর্শন’ মন্দির। বাইরে এটি কেবল কামরূপ কামাখ্যা হিসেবে পরিচিত। নীলাচল পর্বতের ওপরে এর অবস্থান। একসময়ে কামাখ্যাতে উঠিয়া দেবী দর্শন করা বড়ই দুরূহ ব্যাপার ছিল। অতি উচ্চ পর্বতে আরোহনের কোনো পথ ছিল না, তীর্থযাত্রীরা লতা-পাতা, গাছের ডাল ধরে দেবীর দর্শনে যেতেন। তাই হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য কামাখ্যায় সিঁড়ি নির্মাণ করেন। জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় "ব্রহ্মপুত্র নদ হইতে মন্দির পর্যন্ত পাহাড় কাটিয়া একটি সিঁড়ি প্রস্তুত করিয়া দিয়া, যাত্রিগণের আরোহণ ও অবরোহণের ক্লেশ দূরীভূত করিলেন। এই নিঃস্বার্থ কর্মে তাহার নাম চিরস্মরণীয় হইয়াছে। তিনি যে কীর্তি স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, যতদিন হিন্দু ধর্ম থাকিবে, যতদিন তীর্থ ধর্মের মাহাত্ম্য থাকিবে, ততদিন হরিশ্চন্দ্রের নাম সকলের হৃদয়ে সুবর্ণ অক্ষরে মুদ্রিত থাকিবে। তাহার এই নিঃস্বার্থ পরোপকার গবর্নমেন্টের অগোচর রহিল না। তাহার এই সকল সৎকার্যের জন্য ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাণীর “ভারতেশ্বরী” উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে তিনি “রাজা” উপাধি দ্বারা ভূষিত হন।" ময়মনসিংহের জমিদারদের মধ্যে তিনিই প্রথম রাজা উপাধি পান।
রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর পারিবারিক অবস্থা ও দেহত্যাগ ঃ
রাজা হরিশ্চন্দ্র ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। রাজদ্বারে তার বিশেষ সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র লাহিড়ির কন্যা অমৃতসুন্দরী দেবীকে বিয়ে করেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন, এইজন্য মুক্তাগাছার জমিদার বংশ হতে উপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরীকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। শেষ জীবনে হরিশ্চন্দ্র কলকাতা শহরে বাস করতেন। ওই স্থানেই বাংলা ১২৮৯ (ইংরেজি ১৮৮৩) সালে অকস্মাৎ তিনি পরলোক গমন করেন। রাজা হরিশ্চন্দ্রের ধর্মশীলা পত্নী রাণী অমৃতসুন্দরী এই শোকে কাশীধামে গমন করেন। ১৯১১ সালের প্রকাশিত বইয়ে জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, "এখনও তিনি জীবিতা থাকিয়া ধর্মচর্চায় কালাতিপাত করিতেছেন। তিনি তথায় একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।"
রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর দত্তক পুত্র কুমার উপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী ঃ
রাজা হরিশ্চন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র কুমার উপেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেন। তিনি বাংলা ১২৬৮ (ইংরেজি ১৮৬২) সালে জন্মগ্রহণ করেন। উপেন্দ্র চন্দ্র ইংরেজি ও বাংলা ভাষা রীতিমতো শিক্ষাগ্রহণ করেন। তিনি সবসময় ইংরেজি ও বাংলা নানাবিধ পুস্তক পাঠে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করে থাকতেন। একসময়ে তিনি সুদক্ষ শিকারী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ময়মনসিংহ শহরে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্টার জন্য এককালীন সাত হাজার টাকা দান করেন। সিটি কলেজ স্থাপনের সময় এককালীন পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। তা ছাড়াও শহরের জাতীয় বিদ্যালয়ের জন্যও কিছু টাকা দান করেন। কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের জন্য ৫০০ টাকা দান করেন। এ ছাড়াও দাতব্য চিকিৎসালয়, পুকুর খনন প্রভৃতি কাজে তার বহু দান আছে। তিনি অনেক সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করে একজন সুবক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। বাংলা ১৩১১ সালে ময়মনসিংহ শহরে প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশন হয়েছিল তখন তিনি ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে বিশেষ প্রশংসা লাভ করেন। বাংলা ১৩০৪ (ইংরেজি ১৮৯৭) সালের ভূমিকম্পে তার গোলকপুরের রাজপ্রাসাদটি বিধ্বস্ত ও ভূমিসাৎ হওয়াতে তিনি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। বহুমূল্যবান গৃহসামগ্রীও বিনষ্ট হয়েছিল।
পারিবারিক অবস্থা ঃ
কুমার উপেন্দ্র চন্দ্র ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত বাজিতপুর গ্রাম নিবাসী রাজকুমার মজুমদারের কন্যা ইন্দ্রবালা দেবীকে বিয়ে করেন। ইন্দ্রবালা দেবী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও সুশিক্ষিতা ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। তার পিতার মৃত্যুর উপলক্ষে ‘কুসুমাঞ্জলি’ নামে একটি বই রচনা করে পিতা ভক্তির পরিচয় দিয়েছেন। ইন্দ্রবালা দেবীর পিতৃভক্তি, স্বদেশ-প্রীতি ও দয়া-মমতার বিকাশের সাথে কবিতা গুচ্ছ সমৃদ্ধ হয়েছে। কুমার উপেন্দ্ৰ চন্দ্ৰ চৌধুরী পার্থিব জীবনে সকল প্রকার সুখ সৌভাগ্যের অধিকারী হলেও পুত্রধনে তিনি বঞ্চিত ছিলেন। তিনি মুক্তাগাছার জমিদার ললিতকিশোর আচার্য চৌধুরীর পুত্র সত্যেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরীকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
কুমার উপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরীর দত্তক পুত্র সত্যেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী ঃ
ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ হতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৩ সালে গৌরীপুরের ঐতিহাসিক গোলকপুর এলাকায় জরিপকালীন সময়ে পুরাতন জেলাখানা মোড় নিবাসী মো. মমতাজ উদ্দিন (৮৫) বলেন, গৌরীপুরের ১২টি জমিদার বাড়ির মধ্যে গোলকপুরে ছিল একটি জমিদার বাড়ি। বর্তমানে এখানে জমিদারির ইতিহাস আছে, মাঠ আছে ও পুকুর আছে, নেই জমিদার বাড়ি। বর্তমান প্রজন্ম জমিদারির সঠিক ইতিহাস কেউ জানে না। তিনি অতীতের স্মৃতি ঘেটে বলেন, সত্যেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরীর দুই বা তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদের নাম রথীন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী, সুধীন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী....তবে মেয়ের নাম জানা যায়নি। সুধীন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী ছিল তার সমবয়সী ও সহপাঠী। সে সময়ে তিনি পড়াশুনা করতেন কলকাতা ও ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত কুমার উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠে। কথা বলতে বলতে তিনি খানিকটা থেমে তার স্মৃতি মন্থন করতে থাকেন। তারপর বলেন, ঘর ছিল ৬টি, পুকুর ছিল ৩টি। সেখানে বড় ছনের ঘরসহ নানান প্রজাতির গাছপালা ছিল। এলাকাবাসী বলছে, এখানে বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি করে দর্শনীয় পরিবেশ সৃস্টি করে এটিকে কলেজের পার্কের একটি অংশ হিসেবে রূপান্তর করা যেতে পারে। কুমার উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিলন চন্দ্র দেবনাথের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কুমার উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠ উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত গোলকপুরের জমিদার বাবু সত্যেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী। নতুন প্রজন্মের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গোলকপুরের জমিদারির ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
অনুসন্ধানকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, প্রয়াত জমিদার সত্যেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরীর বংশধর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার বরাহনগরে বসবাস করছেন।।
তথ্য সূত্রঃ (১) ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার - শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র) (২) ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ - শ্রী কেদারনাথ মজুমদার (৩) ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব - মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা (৪) ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র (৫) সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে - ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে (৬) নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস - আলী আহম্মদ খান আইয়োব (৭) উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) গৌরীপুর উপজেলা - উইকিপিডিয়া (খ) কলকাতা - উইকিপিডিয়া (৮) বাংলাপিডিয়া (৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ) (১১) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন - দরজি আবদুল ওয়াহাব (১২) ময়মনসিংহের রাজপরিবার - আবদুর রশীদ। (13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal (14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton (15) The History of British India- James Mill (16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation). (17) David Rumsey Historical Map Collection. (18) New York Historical Society.
× মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার: সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী, 01745-213344 (also whatsApp), raihanuddinsarker@gmail.com, Gouripur, Mymensins
সাম্প্রতিক মন্তব্য