logo
news image

সম্ভাবনার নতুন দ্বার অ্যালোভেরার বাণিজ্যিক চাষাবাদ

আবু জাফর আহমেদ মুকুল।।

আমার খুব ইচ্ছা ছিল নাটোরের ঔষধী গ্রাম দেখার। গ্রামটি খুঁজার জন্য আমার সাথে গাইড হিসেবে সাথে ছিলেন বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভাসির্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি এর ইনফরমেশন অফিসার নাজমুল ইসলাম উজ্জ্বল। অবশেষে গত ৪ অক্টোবর, ২০২২ তা সরেজমিনে দেখার সুযোগ হল। মূলত ঔষধী গ্রামটি নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রাম, যেখানে চাষ হয় অ্যালোভেরা, মিসরি দানা, ভূঁইকুমড়া, আলকুচি, তুলসি, হরতকি, আমলকি, বহেরা, বাসক, ঘৃতকাঞ্চন, শতমূলী, শিমুল, অশ্বগন্ধাসহ প্রায় ২০০ প্রকারের ঔষধি গাছ। ঔষধি গাছের চাষাবাদের কারণে আজ গ্রামটি ঔষধি গ্রাম নামেই বেশি পরিচিত। সাম্প্রতিককালে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ গন্যমান্য অনেক ব্যক্তিবর্গ ঘুরে গেছেন এ গ্রামে।

নাটোর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রামের পথের দুই ধার ও জমিতে গাছ আর গাছ। কোনোটিই যেন-তেন গাছ নয়, অনেক জটিল রোগ সারে এসব ভেষজ উদ্ভিদে। গাছের পরিচয়েই খোলাবাড়িয়াকে ডাকা হয় ‘ঔষধি গ্রাম'। ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছের বদৌলতে বদলেছে গ্রামটির নাম। বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা চেতনা এবং কর্ম।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৪৫ বছর আগে নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন আফাজ উদ্দিন। পাশাপাশি কবিরাজি চিকিৎসাও শুরু করেন তিনি। এলাকার সবাই তাঁকে আফাজ পাগলা নামে চেনেন। তিনি নিজে ঔষধি গাছ চাষ করেই থেমে থাকেননি, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলে ভেষজ উদ্ভিদ চাষে। প্রথমে কেউ গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, এটি লাভজনক। পরে অন্যরাও চাষে যুক্ত হন।

ঔষধি গ্রামের ভেষজ চাষিদের একত্র করে এ গ্রামে গড়ে উঠেছে লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ঔষধি গ্রাম সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও কবিরাজ মো. আফাজ উদ্দিন পাগলা। গ্রামের ভেষজ বিপ্লবের এই নেপথ্য নায়ক  ২০০৯ সালে কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক পান। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনে বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। এ গ্রামে উৎপাদিত এসব গাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। ঔষধি গাছকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে ঔষধি বাজার। গ্রামবাসীর উৎপাদিত ভেষজ বাজারজাত করতে গড়ে উঠেছে সমবায় সমিতি।

এবার আসি অ্যালোভেরা প্রসঙ্গে। অ্যালোভেরা অতি পরিচিত একটি নাম আমাদের কাছে, যা বহু গুণে গুণান্বিত। ভেষজ উদ্ভিদ এর মধ্যে এলোভেরা যাকে বাংলায় আমরা ঘৃতকুমারী বলে থাকি তার ব্যবহার কিন্তু সেই আদি যুগ থেকেই হয়ে আসছে। সুপরিচিত এই উপকারী ভেষজ উদ্ভিদ এখন উৎপাদন হচ্ছে বাণিজ্যিক ভাবেও। যদিও এর বাণিজ্যিক ব্যবহার বাংলাদেশ এ নেই বললেই চলে তবুও ভেষজ উদ্ভিদ ফলনে ইদানীং অনেক বেশি জোড়ালো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই আওতায় অ্যালোভেরা চাষে এগিয়ে আসছেন কৃষক এবং নাটোরের বেশ কিছু জায়গাতে এর বাণিজ্যিক চাষে সফল চাষীরা।

অ্যালোভেরা সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে এর জেল এর কথা। প্রসাধনী থেকে শুরু করে জ্যুস সবই আমাদের জন্য উপকারি। অনেকটা আনারসের গাছের মত দেখতে এর পাতাতেও আছে কাটা এবং এটি প্রায় ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। উত্তর-আফ্রিকা, আসলে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চল, মাদাগাস্কার ও কেরানিদ্বীপপুঞ্জ হলো এলোভেরার আদিবাস। এর নামকরণ করেন ক্যারলিনিয়াস। ৬০০০ বছর আগে মিশর থেকে এর উৎপত্তি শুরু হয়, এরপর থেকে আজকের অবস্থানে৷

লিলি গোত্রের এ গাছের পুরো পৃথিবী জুড়ে আছে ২৫০টি প্রজাতি। বাংলাদেশে ২ প্রজাতির অ্যালোভেরা চাষ করা হয় ৷ এ যুগে এসে আমরা বাড়ির ছাদে, বারান্দায় কিংবা জমিতে বা উঠানেও অ্যালোভেরা চাষ করা হয়। কিন্তু তারপর ও যথেষ্ট ব্যবহার নেই উপকারী এই উদ্ভিদের। অ্যালোভেরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে হকারি পণ্য হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়।

নাটোরের ঔষধী গ্রামের রাস্তার পাশে আছে অনেক অ্যালোভেরার বাগান। যেখানে কাজ করে হয়েছেন বেশ কয়েকজন নারীও স্বাবলম্বী। এক বাগান থেকে চারা, পাতা পাইকারি খুচরা  বিক্রি করা হয়৷ যার ফলে গ্রাহক থাকে সারা বছরই। এই গ্রাহকদের আগ্রহের কারণেই অ্যালোভেরা চাষ করে অনেকই আজ সফল এবং স্বচ্ছল।

অ্যালোভেরা চাষে মূলধন লাগে কম। জমিতে তেমন সারের প্রয়োজন নেই। জৈব সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করে চারা রোপন করতে হয়৷ অনেক চাষীরা প্রচুর ছাইও ব্যবহার করে থাকেন। বছরের যে কোন সময় চারা রোপন করা গেলেও জুন বা আষাঢ়ের শুরুতে চারা লাগালে গাছ দ্রুত বাড়ে। অ্যালোভেরা গাছের গোড়া থেকেই চারা বের হয় অনেক, সেই চারা লাগিয়ে আবারো শুরু হয় পাতা উৎপাদন৷ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের সময় অনেকেই মোথা কেটে বাদ দিয়ে পুরোনো চারা লাগান, এতে দ্রুত পাতা পাওয়া সম্ভব হয় ৷ এক বিঘাতে গড় হিসাব করলে ২৫০ মন অ্যালোভেরা পাওয়া সম্ভব যা থেকে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হতে পারে।

চারা থেকে আয়, পাতা থেকে আয়, লাভের অংকটা শুধু এখানে সীমাবদ্ধ না। অ্যালোভেরার উপকারীতা অনেক। এর মধ্যে এখানে কিছু তুলে ধরছি:

# অ্যালোভেরার পাতার ঠিক নিচেই থাকে হলুদ রঙের ল্যাটিস, যার নীচে থেকে আমরা পাই জেল৷ এই জেলের জ্যুস হার্ট সুস্থ রাখে৷ রক্তের ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমিয়ে দেয়৷

# যেকোন ব্যাথায় অ্যালোভেরার জেলের ক্রিম লাগালে ব্যাথা কমে যায়।

# ত্বকের যত্নের কথা যদি আমরা বলি তবে বলতেই হয় যে এর এত্ত উপকারীতা যে বিউটি পার্লার হলো অ্যালোভেরার রেগুলার ক্রেতা৷ এর মধ্যে থাকা এন্টি ইনফ্লামেন্টরি উপাদান থাকে যা ত্বকের অনেক ধরণের ইনফেকশন দূর করে।

# দাঁতের ইনফেকশন দূর করে, দাঁত এর ক্ষয়রোধ করে অ্যালোভেরা।

# মুখের ঘা ভালো করে অ্যালোভেরা জেল। মুখের দূর্গন্ধ দূর করে।

# চুলের যত্নে এলোভেরার গুণ অত্যন্ত বেশি৷ ঝলমলে সুন্দর চুল সম্ভব অ্যালোভেরার জেল ব্যবহারের মাধ্যমে। মাথায় খুশকি দূর করে৷

# অ্যালোভেরাতে প্রায় ২০ রকম অ্যামাইনো এসিড আছে যা ইনফ্লামেশন এবং ব্যাকটেরিয়া রোধ করে৷ বুকে জ্বালাপোড়া কমে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে।

# এছাড়াও আমরা জানি যে অ্যালোভেরা জেল খুবই ভালো হাইলাইটার হিসেবে কাজ করে এবং এর জেল ত্বক উজ্জ্বল করে, চোখের নীচের কালিও দূর করে৷

অনেক অনেক গুণ সম্পন্ন এ অ্যালোভেরা অতি সুপরিচিতও বটে, এরপরও এর মার্কেট এত ছোট৷ বড় পরিসরে অ্যালোভেরা বিক্রি হচ্ছে আমাদের দেশে সেই বাজারটা এখনো গড়ে উঠেনি। আসলে অ্যালোভেরা রেখে খাওয়ার মতও জিনিস না, কিংবা এর জ্যুস যে রেগুলার খাওয়া হবে সেই বাজার এখনো তৈরি হয়নি। যার জন্য অনেক সম্ভাবনাময়ী এ পণ্য এখনো মাথা উঁচু করে উঠতে পারছে না অথচ এই পণ্যের অনেক সম্ভাবনা আছে, সম্ভাবনার এই দিকগুলোই শুধু তুলে ধরা প্রয়োজন।

তবে সেভাবে না ভাবলেও বা জানলেও সম্ভাবনার দিকও আছে কিন্তু। যেমন অনেক হার্বাল ওষুধ কোম্পানির সাথে যদি চুক্তিবদ্ধ হওয়া যায় বা তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা যায় তবে তারা নিজে থেকে চাষীদের বাড়ি থেকে এসে অ্যালোভেরার পাতা নিয়ে যান।

অ্যালোভেরা থেকে শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, অন্যান্য সব ধরণের প্রসাধনী তৈরি হচ্ছে তবে হ্যা সেই ম্যানুফেকচার কোম্পানি আমাদের নেই বললেই চলে তাছাড়া আমরাও প্রসাধনী সামগ্রী বলতেই যেন বিদেশীতে অভ্যস্ত। একদিনে বদলাবে না তবে বদল হবে এসব কিছুরই ধীরে ধীরে সময় নিলে, উদ্যোগ নিলে, ছড়িয়ে দিলে এবং সম্ভাবনার কথা তুলে ধরলে।

তবে আশার কথা হচ্ছে ঢাকায় অনেক ওষুধ কোম্পানি আছে বা অ্যালোভেরা প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশ পাঠায় এমন কোম্পানি আছে, যারা সরাসরি অ্যালোভেরা রপ্তানি করে৷ যেহেতু তারা সরাসরি মাঠপর্যায়ের চাষীদের থেকে এগুলো সংগ্রহ করে তাই এটি বিশাল একটি সম্ভাবনা তৈরি করছে। চাষীরা লাভের মুখও দেখছে এবং আগ্রহ হচ্ছে এই সেক্টরে। স্কয়ার, একমি, হামদর্দসহ ছোট-বড় ১৫০ থেকে ২০০ কোম্পানি আছে যারা প্রতিনিয়ত অ্যালোভেরা নিয়ে কাজ করছে। শুধু তাদের সাথে যোগাযোগ করার মত সেইরকম একটা মিডিয়া প্রয়োজন।

এমন একটি কোম্পানি হলো তাইওয়ান ফুড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, যার কথা না বললেই নয়, এটি ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত এবং এরা অ্যালোভেরার রেগুলার প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করে তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তেয়াজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এখানে দিনে ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন অ্যালোভেরার চাহিদা থাকে কিন্তু পাচ্ছে রেগুলার ১৫ মেট্রিক টন। এই জায়গাতেই ঘাটতি আছে কত্ত এলোভেরার, যা খুব সহজেই সাপ্লাই দেওয়া যায় চাষীদের থেকে। তবে তা তখনই সম্ভব হবে যখন চাষীরা এই ব্যাপারটি জানবে।

এছাড়াও আরো কয়েকটি কোম্পানি থেকে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আবুধাবী, কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরো বিভিন্ন দেশে অ্যালোভেরা পাঠানো হচ্ছে। প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে এর চাহিদা বেড়ে চলছে৷

যেহেতু দেশের ভেতরে এর মার্কেট ছোট, নাই বললেই চলে তাই চাষীরা এখনো এ-মুখী হচ্ছে না। অথচ বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব অ্যালোভেরা থেকেই কেননা এর চাহিদা অনেক বেশি।

অ্যালোভেরার বাজার আছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারও তৈরি হবে তখনই যখন এ সম্পর্কে মিডিয়া সোচ্চার হবে এবং প্রচার বাড়াবে। কেননা কোন চাষীই বাজার ছাড়া পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হয় না। এর জন্য প্রয়োজন কোম্পানির সাথে মাঠপর্যায়ের লোকেদের যোগাযোগ রক্ষার সুন্দর একটি মাধ্যম। যেহেতু ওষুধ এবং প্রসাধনী ইন্ডাস্ট্রিতে এর ব্যাপক প্রয়োগ আছে তাই এর রপ্তানি বাজার আরো বাড়বে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারও। নাটোর সদর উপজেলায় চাষীরা সফল হচ্ছেন এবং উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও যেহেতু সোচ্চার এ বিষয়ে তাই অনেকের মাঝে এর প্রসার, সচেতনতাবোধ এবং আগ্রহ তৈরি করতে বেশি বেশি প্রচার করা প্রয়োজন। ই-কমার্স সেক্টরে এ নিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি হলে চাষী এবং কোম্পানী বা গ্রাহকদের মধ্যে সুন্দর সুষম যোগাযোগ তৈরি হবে অবশ্যই।


* আবু জাফর আহমেদ মুকুল: হযোগী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top