আমার দেখা সাস্টিয়ান: ২০-উদিত সূর্য
।।হিমাংশু শেখর সূত্রধর।।
বিংশতম গল্পটি নবারুণকে দিয়েই শুরু করি। বিশে (বিষে) বিষ ক্ষয়। একটা মহামারী দেখলাম আমরা সকলেই। ২০২০! আগেও বিশ, পরেও বিশ। একটি সন, একটি জ্ঞান, একটি পরিচয়, একটি অনুধাবন। নবারুণ আসলেই বিশেষ একজন।
একটা পরিচয় যদি একটা জ্ঞান হয়, তাহলে তাকে আমি প্রথমে চাক্ষুষভাবে দেখি সাস্টের মিনি অডিটোরিয়ামে, ছাত্রলীগের এক নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি ঠিক সেইভাবে জমছিল না। হঠাৎ একজন গোঁফওয়ালা স্টেজে উঠলেন এবং হাঁক দিয়ে বললেন যে, আজ তিনি সবাইকে নাচিয়ে ছাড়বেন। আমিও তখন অন্য সবার মতো দর্শক সারিতে। গাইলেন শচীন কর্তার সেই বিখ্যাত গান, 'বাঁশি শুনে আর কাজ নাই.. সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।' সবাই দৈহিকভাবে না নাচলেও, অন্তত মানসিকভাবে নেচেছিলাম। ব্যাপারটা এমন নয় যে, সে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পি। হয়তো কিছুটা ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়েই মাইক হাতে নিয়েছিল। এর পেছনে যে কমিটম্যান্ট বা স্পিরিট্, সেটাই মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট ছিল। আমাকে নিয়ে তার চাক্ষুষ শুরুর পরিচয়টা কেমন, সে বিষয়ে আমি একেবারে কনফার্ম নই। যাই হোক সেই চেনার পথ ধরেই তারপরে ঘনিষ্ঠতা। কত কথা বলব? কতই বা বলা যায়।
ক্যাম্পাসের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মিছিলটির কথাই বলি। আগের রাতে শাহপরান হলে ডোর টু ডোর ওয়ার্ক করা হল। পরের দিন পিক আওয়ারে মিছিল হবে। কিন্তু পরের দিন প্রকৃতি হলো বিরূপ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা গুটি কয়েকজন সেই সময়ের গোল চত্বরের পাশের সোনালী ব্যাংক ও ক্যান্টিনের বারান্দায় সিদ্ধান্তহীনতায় কেউ ঘুরাঘুরি করছি, কেউবা বসে আছি। নবারুণ হলে গেলেন। মিনিট দশ পনেরো হবে, আমরা দেখলাম, পুরো শাহপরান হল থেকে সকল ছাত্রদের বৃষ্টিস্নাত ক্যাম্পাসে, নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসছেন তিনি। বিস্ময়ে, আনন্দে সকলেই হাততালি দিয়ে উঠলেন। হল এবং ক্যাম্পাসে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে সে এক বিরাট মিছিল, যার শুরু আছে বাট শেষ নেই।
কত কথা বলব সেই স্বর্নালী সময়ের, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ এমনকি এখন পর্যন্ত! পাঠক ভারাক্রান্ত হতে পারেন।
চাঁদের ছায়ায় এরশাদ টিলায় কিংবা বিকেলে উপত্যকায়, ক্যাফে, ক্যান্টিন, ডিশ রুম, ব্রাহ্মণশাসন থেকে রেডিও বাংলাদেশ টুকুরবাজার.. কোন জায়গার কথা বলব?
আইপি বারান্দার কথা বলব? বাস্কেটবল বল গ্রাউন্ডের পাশে, শবে-বরাতের রাতে পাওয়া অফুরন্ত সুপেয় পানির কথা বলব? নাকি প্লুটোতে থাকা অবস্থায় স্লেটের উল্টো পাশে প-বর্ণ লিখতে বলায়, এবাউটটার্ন হয়ে যাওয়া নবারুণ এর কথা বলব।
রাতের পর রাত নির্জন শাহপরান হলে সহযোদ্ধাদের নিয়ে থাকার কথা বলব? নাকি হঠাৎ ডিসিশনে মরহুম জয়নালের জন্য সদল বলে রাতের ট্রেনে ঢাকা যাবার কথা বলব। সেই যাত্রায়, যাবার আগে বাসায় গিয়ে, মাকে বলে, একই কাপড় পরিবর্তন না করেই, দরজার চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে যে বেড়িয়ে এলি, সেই দৃশ্যের কথা ভুলি কি করে?
রাজনীতি তো রক্তেই ছিল। তার কথা আলাদা করে আর নাই বলি। মিছিল, মিটিং, স্লোগান, কাউন্সিল আর নির্বাচনের উত্তাল দিনগুলোর কথা। ফায়ার, ফায়ার, টুল্লুস, টুল্লুস।
কাউয়া তাড়ানির কথা কি ভুলা যায়? কাউয়ায় ধান খাইলো রে, খেদাইবার মানুষ নাই, খাইবার বেলায় আছুইন মানুষ, কামের বেলায় নাই, কাউয়ায় ধান খাইলো রে।
মশার অত্যাচারের কথা তো বলতেই হয়। মনে পড়ে, মশা মানে ইউসুফ! হা হা হা। কচু বনের মশারে তোর লম্বা লম্বা সুড়। আরে এক্ এক্ কামড় মারে মশায়, যেন কুড়ালের কোপ রে, পাগল করিল বনের মশায় রে.....।
উত্তম-সূচিত্রার কথাই বাদ যাবে কেন? নিশি রাইত ত্যারা চাঁন আসমান, লুকাই লুকাই চুঙ্গা বাজায় বাঁশবন..বাঁশবন।
এত কথা বকলাম কিন্তু ঐতিহাসিক ৪৩৬/ডি শাহপরান হলের কথা কি বলা উচিত নয়? আমাদের পঞ্চ পাণ্ডবদের রুম। আমি, তুই, সাদিক, তাপস আর ওয়াদুদ। অনেক ঘটনার সাক্ষী, অনেক ঘটনার জন্ম যে রুমটাতে। আমাদের নিউক্লিয়াস।
ক্যাম্পাসের জীবন শেষে ঢাকার তেজকুনিপাড়ার বেকার অবস্থায় যাপিত কিছুদিনের স্মৃতিও মাথায় ঘুরপাক খায়।
এক সময় চাকুরী নামক সোনার হরিণ পেলি তুই আর সাদিক। দুজনেই বিমানে আলাদা সেক্টরে। দুইজনেই ট্রেনিং-এ, প্রথম স্থান অধিকার করলি। বেকার আমি তোদের বাসায় এলাম। কোন জায়গায় তা এতদিন পরে মনে নাই। দরকারও নাই। আমার উস্কুখুস্কু চুলে চিরুনি চালিয়ে যে আঁচড়িয়ে দিলি, সেটা ভুলি কি করে?
আর মনে কি পড়ে, চাকুরী পাবার পর, সিলেটের মজুমদারিতে বাবুর বাসা থেকে আমরা সবাই মিলে রাত তিনটায় যে চলে গিয়েছিলাম আবার ক্যাম্পাসে। সাস্টের কর্মচারী তসলিম ভাই, নুর ভাইদের জাগিয়ে তুললাম। ঘুম ঘুম চোখে সবাই অবাক। আবার টাকাও দিচ্ছি সবাইকে। না, কোন বাকী খাবার পাওনা টাকা নয়! সম্পর্কের টাকা!! বাকি তো খাই নি কোনদিন। আর কার কার কথা বলব? দেওয়ান চাচার কথা, ড্রাইভার শ্যামল দা, রুপিয়ান ভাইদের কথা? হল ক্যান্টিনের জামান ভাই এর কথা, ডাইনিংয়ের বাছিতের কথা। ক্যান্টিনের সবুজ ভাই, মিলনের কথা। জগৎজ্যোতিদের কথা।কর্মচারীরা এখনো আমাদের মনে রাখেন । এখনো ভালবেসেই যায়!
না, সাধারণ পাঠক বোধ হয় একটু বিরক্তই হচ্ছেন। ক্ষমা চাই ভাই আপনাদের কাছে। একটু নষ্টালজিক হয়ে গেছি। নবারুণ হল উদিত সূর্য। সাস্ট ফোর্থ ব্যাচ, সমাজকর্মের এই ছেলেটি আমাদের চার রসায়ন রুমমেটের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল। বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন পরিবারসহ। এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক তিনি। কিছুকাল হয় একটি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আমার এই বন্ধুর জন্য সকলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবেন।
গল্পের ছলে, ছলনাক্রমে কত ছাইপাশ উদগীরণ করলাম হে নবা। ভালো করলাম নাকি খারাপ করলাম সে দায়ভার নিতেও রাজি নই! রাজা বটে, তুমি যে মিঃ এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্যাখ্যানিয়া! ভালো থাকিস নবারুণ, ভালো থাকিস।
* হিমাংশু শেখর সূত্রধর: সহকারী অধ্যাপক (রসায়ন), বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ; সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সাম্প্রতিক মন্তব্য