logo
news image

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কো স্বীকৃতি: নেপথ্য কথা

ইমাম হাসান মুক্তি, লালপুর (নাটোর)
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই ভাষণে স্বাধীনতাকামী সাত কোটি বাঙালিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ঘোষণা করেন।
এ স্বীকৃতির নেপথ্যে রয়েছে এক বাঙালি নারীর বিশেষ অবদান। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুঘটক হিসেবে ছিলো তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তিনি হলেন ঢাকার বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রোকেয়া খাতুুন।
বিশেষ সাক্ষাৎকারে রোকেয়া খাতুন বলেন, তিনি ২০০৩ সালে ২২তম বিসিএসএস (শিক্ষা) ক্যাডারে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। পরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গবেষণা কর্মকর্তা, ঢাকার ইডেন কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রেষণে বদলি হয়ে ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো’য় প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপে ‘অন দ্য ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বাংলাদেশের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যগত গুরুত্ব ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নথি বা প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপনের দায়িত্ব পান। তিনি এমন কিছু তুলে ধরার পরিকল্পনা করেন যা বিশ্বে ভিন্ন এক স্বীকৃতি লাভ করতে পারে।
তাঁর মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর বুকে একমাত্র নেতার একটি ভাষণই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। যা বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে প্রতিরোধ যুদ্ধের শক্তি যুগিয়েছিল। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ইউনেস্কোর তালিকায় ঠাঁই পেতেও যে ভাষণের রয়েছে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর তৎকালীন সচিব আব্দুল খালেকের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করলে উৎসাহ দেন। সেই ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আর প্রভাব বিশ্বের ফোরামে তুলে ধরতে শুরু হয় গবেষণা। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে সহযোগিতা করেন। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপ অন দ্য ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’।
ওই কর্মশালায় (২০১১ সালের ১১-১৪ মার্চ) বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মিয়ানমার, পালাও, পাপুয়া নিউগিনি, ফিজি, সলেমন দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব তিমুরসহ ১১ দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। এতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কার মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ)-এর তৎকালীন চেয়ারপারসন রোজলেন রাসেল, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়ারপারসন রে অ্যাডমন্ড সনসহ পাঁচজন বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের ভাষণের ওপর রোকেয়া খাতুনের উপস্থাপনা প্রশংসা পায়।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়ারপারসন রে অ্যাডমন্ডসন ভূয়সী প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণের গুরুত্ব উপস্থানে বেশকিছু মতামত ও পর্যবেক্ষণ দেন। থাইল্যান্ডের আবহাকর্ন মনোনয়ন আরও শক্তিশালী করতে ভাষণের পেছনের ব্যাক্তি-ক্যামেরা, শব্দগ্রহণ প্রভৃতি কাজে যুক্তদের বিষয়টি তুলে ধরার পরামর্শ দেন।
ফোরামে বিষয়টি উপস্থাপনের দীর্ঘদিন পর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। যে তালিকায় ৪৮ নম্বর স্থান পায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
বিশ্বব্যাপী আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা, যুদ্ধের হুংকার, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে এমন সম্পদ যখন বিনষ্টের পথে, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অনেক দলিল যখন নষ্টের ঝুঁকিতে, সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রোগ্রাম চালু করে ইউনেস্কো।
রোকেয়া খাতুন জয়পুরহাট জেলার নতুনহাট সরদারপাড়ার সরদার মমতাজুস সামাদের দ্বিতীয় সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তিনি নাটোরের লালপুরের মুরদহ গ্রামের শাহ মিজান শাফিউর রহমানের স্ত্রী। শাফিউর ২০তম বিসিএস (পুলিশ) কর্মকর্তা রংপুরের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে কর্মরত।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top