তিলোত্তমায় দড়ি বাঁধা বাম্পার তেলচিটে সিট
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
তিলোত্তমা ঢাকার রাজপথে আমাদের সামনের সিডান গাড়িটা হঠাৎ সজোরে ব্রেক কষে ক্যাঁ ক্যাঁ করে উঠলো। তার সামনে একটি ভারী বস্তু ঝন ঝন করে পড়ে গড়িয়ে তার সম্মুখে আসতে লাগলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সামনের চাকা ফেঁসে গেছে একটি বড় লৌহদন্ডের উপরে। পিছনের সব গাড়ি কষা ব্রেকের ঝাঁকুনি দিয়ে এক এক করে থেমে গেল। ড্রাইভার নেমে বুঝতে পারলো একটি বড় বাসের পিছনের বাম্পার হঠাৎ খসে পড়েছে রাজপথে। তার শরীরে একটি ছেঁড়া রশি এখনো বাঁধা রয়েছে। বাম্পার খসে পড়া বাসটি দ্রুত গতিতে সামনের দিকে পালাতে গিয়েও গাড়ির চাপে থেমে গেছে। বাসের যাত্রীরা শব্দ শুনে ভয়ে দ্রুত নেমে পড়েছে। তবে কারের সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি ও জড়ো হওয়া জনতার আক্রোশ দেখে বাসের ড্রাইভার ও হেল্পার রাস্তায় বাস রেখে উধাও হয়ে গেছে। দীর্ঘক্ষণ পর ট্রাফিক-পুলিশ এসে বাসটি সরানোর ব্যবস্থা করলে পিছনের জ্যাম সামনের দিকে এগুনোর সাড়া পেল।
তিলোত্তমার কোলে প্রতিদিন এই রকম নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সুন্দরী ঢাকার শরীরে সার্জারী করে সৌন্দর্য বর্ধনের চর্চা কোনদিন থেমেছে বলে জানা যায়নি। সারা বছর শহর জুড়ে নির্মাণ কাজ হচ্ছে। রাস্তা, ড্রেন, ডিভাইডার, ফুটপাতে খোরাখুরি চলছেই। মাদকাসক্তরা ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে নিয়ে ভাঙ্গারীর দোকানে বিক্রি করে মাদকের টাকা যোগাড় করে বলে অপবাদ রয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই থৈ থৈ পানিতে ম্যানহোলের উন্মুক্ত সেসব গর্তে রিক্সা ও গাড়ির চাকা ফেঁসে যায়। মানুষ হরদম আহত হয়, মারা যাবার নজিরও রয়েছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে একব্যক্তি রাস্তার বড় গর্তের পানিতে ভেসে গেছেন। তাকে ফায়ার ব্রিগেড কর্মীরা এসে জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা করার আগেই তিনি অজানা জগতে পাড়ি জমিয়েছেন বলে সংবাদে জানা গেছে। আমরা সিসি ক্যামেরার বদৌলতে তার নিমিষেই অথৈ পানিতে তলিয়ে যাবার করুণ দৃশ্য দখেছি টিভিতে।
গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে সেবা ব্যবস্থার দুরাবস্থা সবার নজরে আসে না। শুধু নিম্ন আয়ের উপায়হীন মানুষরা যারা প্রতিদিন এসব ভাঙাচোরা গাড়িতে যাতায়ত করেন তারাই ভাল বলতে পারবেন তিলোত্তমার তিলের নিচে জমে থাকা কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথাগুলো। অনন্তকালব্যাপী চলা নির্মাণকাজের বদৌলতে ধুলায় ঢেকে থাকা রাজধানী ঢাকায় টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাবানরা ব্যক্তিগত গাড়িতে জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে ঠান্ডা বাতাস চালু করে চলাচল করেন। জ্যামে পড়লে কেউ রাস্তায় ঘুমিয়ে নন। অথবা ইন্টারনেট দেখে সময় পার করে দেন। যত মুষ্কিল হলো দড়িতে বাম্পার বাঁধা বাসে চলাচলকারীদের।
রাজপথে হাল-ফ্যাশন গাড়ির হেডলাইটের আলোর ঝলকানি বাড়লেও গণপরিবহণকারী বাসের সিংহভাগ লক্ক্র-ঝক্কর মার্কা। বাইরের দেহে যেন খোষ-পাঁচড়া, চুলকানি ধরে চামড়া উঠে গেছে। অনভিজ্ঞ চালকরা অন্য গাড়িতে নিজের গাড়ির বডি ঘষিয়ে যেন সেই চুলকানির মজা পান। অধিকাংশ বাসের জানালার কাঁচ ভাঙ্গা। সিটের কভারে ময়লা তেল চিটচিটে ভাব তিলোত্তমার দেহের ভেতরে তালোড়ার তিলের তেল মাখানো হয়েছে বলে মনে হয়। এ অবস্থা চল্লিশ বছর পূর্বে যেমনটি ছিল, আজও তেমনি রয়ে গেছে। ভিতরে ঘিন ঘিন পরিবেশ। অন্যায়ভাবে সিটের সংখ্যা বাড়ানোর ফলে বাসে বসে পা সোজা করে থাকার উপায় নেই বহু গাড়িতে। অনেক গাড়ির ব্রেক ঠিকমত কাজ করে না। গিয়ার ঘড়ঘড় করে।
করোনার ভয়াবহ আক্রমণ কিছুটা কমলেও রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড সহ ইউরোপের বহু দেশে পুনরায় লকডাউন শুরু হয়েছে। জামার্নীতে নভেম্বর ১২ তারিখে একদিনে পুনরায় ৫০ হাজার মানুষের দেহে করোনা সংক্রমণ নতুন করে ভীতির সঞ্চয় করছে সারা পৃথিবীর মানুষকে। আমরাও তৃতীয় ঢেউয়ের আমনী বার্তা নিয়ে ভয়ে তটস্থ আছি, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধিকে ঝেঁটিয়ে উধাও করে দিয়েছি।
করোনার সময় ব্যক্তি দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে বলা হলে কিছুটা স্বস্থিবোধ হতো। এখন বাসে পুনরায় গাদাগাদি করে চলাচল করতে হচ্ছে। গাড়ি চলাচল শুরু হতেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। করোনায় দিনে ২-৩ জন মৃত্যুবরণ করলেও গাড়ি চাপা ও সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিদিন ৩০-৪০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
এরই মাঝে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করা হলে বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে শুরু হয়েছে চরম বিপত্তি ও নৈরাজ্য। এত গাড়ি এত বিশৃংখলা নিরসনে যাচাইকারী সামান্য কয়জন? তারা সকল বাস পরখ করে দেখবেন কতক্ষণ?
গ্রাম থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় আসেন নানা কাজে। নদীভাঙ্গা অভাবী ছিন্নমূল মানুষেরা আসেন অগণিত সংখ্যায়। তাদেরও প্রধান বাহন তিলোত্তমা ঢাকার এসব ময়লা নোংরা পরিবহন। এতদিন কিছুটা সস্তা হলেও এখন জ¦ালানীর মূল্য বৃদ্ধির ফলে তাদের কাছেও বাড়তি ভাড়া সৃষ্টি করেছে চরম বিপত্তি।
যখন সিএনজি-র দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল তখন বাস মালিকরা এর প্রতিবাদে বাস ভাড়া বৃদ্ধি করেছিল। কারণ, তাদের বাসগুলো সিএনজিতে চলে বলে দাবী করা হয়েছিল। এবার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করার ফলে পুনরায় বাস মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। তাহলে সিএনজি চালিত বাসগুলো কি রাতারাতি ডিজেলে রুপান্তারিত করে ফেলা হলো?
নাকি লোভের জন্য, লাভের আশায় চালাকি করে অসত্য কথা বলা হচ্ছে? নাকি বাসগুলো উভয় প্রকার জ¦ালানি দিয়ে দ্বিবিধ সিস্টেমে চালানো যায়? কোনটি তাদের সঠিক বাচ্য? যদি বাসগুলো সিএনজি চালিত না হয় তাহলে তখন কেন অসত্য কথা বলা হয়েছিল? বেসরকারী গণপরিবহনের উপর সরকারের এসব তথ্য কি নেই? বেশীরভাগ বাস মালিক তো সরকারী দলের সাইনবোর্ড নিয়ে চলাচল করে থাকে। তাহলে এত জালিয়াতি সরকার সহ্য করবে কোন যুক্তিতে?
এসব জালিয়াতি দেখভালের জন্য কেউ কি সজাগ আছেন? তারা দায়িত্ব ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকলে গণপরিবহনে এসব অনৈতিক চালাকি, জোচ্চুরি ও নৈরাজ্য দূর করা অসম্ভব।
পরিবহন মালিকগণ গাড়ি ব্যবসায় প্রচুর আয় করেন। তারা দেশের ধনী ও বিত্তশালী মানুষের প্রতিনিধি। তাই শুধু নিজেদের লাভের কথা না ভেবে জনকল্যাণের জন্য তাঁদেরকে ভাবতে হবে। নিম্নআয়ের মানুষের সেবায় তাঁদেরকে যত্নবান হবার আহবান করছি। ময়লা নোংরা বাস রাস্তায় চলতে দিয়ে আপনারা নিজেরা নতুন এসি-সিডান বিলাসবহুল গাড়িতে চলাচল করবেন তা নিয়ে নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করুন। কারণ, মানুষ মানুষের জন্য। বনের বাঘ এখন মানুষকে তেমন খেতে আসে না। মনের বাঘই মানবতাকে কষ্ট দেয়।
দড়ি বাঁধা বাম্পার, ছাল-চামড়া ওঠা দেহ, তেলচিটচিটে ময়লা সংকীর্ণ সিটে গর্জন করা ইঞ্জিন সম্বলিত বাস রাস্তায় চলাচল করতে দিয়ে আর নিজেদের মনের সংকীর্ণতাকে জনগণের নিকট প্রকাশ না করলেই তাঁরা মানুষের ভালবাসা পেতে পারেন। ডিজিটাল যুগের দোহাই দিয়ে ম্যনুয়াল যুগের মেয়াদউত্তীর্ণ জীর্ণ বাসের মালেক সেজে বাস মালিক হবার গৌরব নেয়াটা কি সমীচিন? বিশেষ করে দড়ি বাঁধা বাম্পার রাজপথে খসে পড়ে তিলোত্তমা উপাধিপ্রাপ্ত রাজধানীর বুকে বার বার দুর্ঘটনা ঘটুক তা এ যুগের দরিদ্র যাত্রীরাও চান না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য