logo
news image

কঠোর বিধিনিষেধ দেখতে ঘরের বাইরে কৌতুহলী জনতা

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম:
করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ভয়াবহ সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী সাত দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয় ১ জুলাই ২০২১। জরুরী সেবাদানকারীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ যেন অহেতুক ঘরের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য ২১টি শর্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। শর্তগুলো গণমাধ্যমে বার বার প্রচার করা হচ্ছে। এজন্য রাস্তায় নেমেছেন সেনাবাহিনী, আনসার, পুলিশ। বড় রাস্তায় বিশেষ চেকপোষ্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশী জোরদার করা হয়েছে। প্রথম দিন টিভিতে দেখা গেল, গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে রাস্তায় বের হবার কারণ জিজ্ঞেস করার সময় পাশে ঘিরে রয়েছে বহু কৌতুহলী মানুষ। মানুষগুলো মজা করে জরিমানা বা শাস্তি দেয়া হচ্ছে কি-না তা দেখার জন্য গাড়ির পাশেই হা করে তাকিয়ে রয়েছে!
অজ্ঞ মানুষগুলো মনে করছেন পুলিশ গাড়ি আটকাচ্ছে- ব্যাপারটা বেশ মজার। না কি কোন তামাশা? দ্বিতীয় দিন থেকে কৌতুহলী জনতাকে রাস্তায় বের না হতে কোথাও মাইকিং করা হয়েছে। তারপরও নানা অজুহাত তাদের মধ্যে। তৃতীয় দিন তাদেরকে বিনা কারণে রাস্তায় বের হবার জন্য জরিমানা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, অহেতুক ঘরের বাইরে বের হওয়া হাজারের অধিক উৎসুক জনতাকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। এগুলো বড় বড় রাস্তায় ঘটেছে।
শহরাঞ্চলের অলি-গলিতে বাধ মানছেন না মানুষ। ঘরের বাইরে বের হবার জন্য নানা অজুহাত তাদের মধ্যে। গলির মানুষকে বাইরে বের হওয়া থেকে ঠেকানোর জন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর কোন তৎপরতা নেই। বলা হয়- শুধু ঢাকাতেই বায়ান্ন হাজার বাজার তেপ্পান্ন হাজার গলি। সেগুলোতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেখলে মানুষ হুড়মুড় করে দোকানের শাটার টেনে দিয়ে শট্কে পড়ে। ওসব নির্বোধ জনতাকে ঠেকানোর জন্য এত পুলিশ কোথায়? অথবা তারা করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনও সচেতন না হয়ে পুলিশের সাথে বিড়াল-ইঁদুর খেলতে থাকলে কার কী দায় পড়েছে যে সারাদিন ওদের সাথে সেই খেলা খেলতে হবে?
কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় নিয়ম-কানুন ভেঙ্গে চলতে চায়। উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বড়-ছোট নির্বিশেষে এ ধরনের ‘কিছু মানুষ’ সব জায়গায় লক্ষ্যণীয়। আইন, বিধি, নৈতিকতা ইত্যাদি তাদেরকে দমাতে পারে না। তারা নির্বোধ, স্বার্থপর অথবা ’মব’ বা উচ্ছৃংখল জনতা। সুযোগ পেলে তারা আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়। নিজে অপরাধ করতে ভয় পায় না। অপরকে দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ড করিয়ে নিজে ফায়দা লুটে নেবার তালে থাকে। তারপর অপরাধের দ্বারা সংঘটিত ক্ষমতা ও কাজের মুনাফা ভাগাভাগি করে জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত থাকে।
এই ধরনের কৃতকর্মের ফলে যে সমাজ ও জীবন-যাপন ব্যবস্থা তৈরী হয় তা এক ধরনের কপটতা ও দুর্নীতিকে উস্কে দিয়ে মানুষকে স্বার্থপর ও অনৈতিক হবার কুশিক্ষা দেয়। এরূপ অন্যায় দেখে বা শিখে সেখানকার মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ বেশী হয়ে একটি অসম সামাজিক ব্যবস্থা তৈরী হয়। এভাবে একটি মন্দ সামাজিক নীতির মধ্যে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ভাল-মন্দের পার্থক্য চিহ্নিত করার মত ‘মানুষ’ তৈরী হওয়া দুষ্কর। বলাবাহুল্য, আমাদের সমাজে টাকাওয়ালাকে বাহবা দেয়া হয় কিন্তু টাকা কীভাবে অর্জিত হলো বা কীভাবে সে টাকাওয়ালা হলো- তা বহুলাংশে আড়ালে রাখা হয়। এতে দুর্নীতির বিস্তারের ফলে সমাজে চরম আয় ও ক্ষমতা বৈষম্য দেখা দেয়। ক্রমাগত এ ধরনের বৈপরীত্য ও বঞ্চনা থেকে জনমনে ব্যাপক সামাজিক ঘৃণা সৃষ্টি হয়।
এই ধরনের অসম সামাজিক ব্যবস্থায় কোন নির্দেশনা এক শ্রেণির মানুষ মানে, অন্য শ্রেণির মানুষ সেটাকে অবহেলা করে অমান্য করে ও সামাজিক বিশৃংখলা ও ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।
যেমনটা ঘটেছে আমাদের মত চরম আর্থিক ও নৈতিকভাবে বৈষম্যমূলক সমাজে। নিম্নআয়ের মানুষগুলো কঠোর লক্ডাউন কী-তা বোঝে না। তারা দিন আনে দিন খায়। সকাল হলেই তারা শুধু বোঝে তাদেরদেক ক্ষুধার আহার জোটানোর জন্য কোদাল-টুকরি নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে শ্রম বিকানোর খোঁজে সকালে লাইনে দাঁড়াতে হবে। তাইতো মাটিকাটা শ্রমিকরা লক্ডাউনের দিনেও রাজধানীর রাস্তার মোড়ে কোদাল-টুকরি নিয়ে বলছে- “বাইরে না বের হলে আমাদের খাবার দেবে কে?” এভাবে সারা দেশের বড় রাস্তার মোড়ে কত শত শ্রমিক পেটের দায়ে লকডাউনেও কাজের জন্য অপেক্ষা করছে কে জানে?
রাস্তায় রিক্সা চলার অনুমতি দেয়া হয়েছে একই কারণে। কিন্তু অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, বন্ধ থাকায় ভদ্রমানুষ ঘরের বাইরে বের হয়নি। তাই বিধিনিষেধের সময় নিম্নশ্রেণির মানুষের শ্রমের খদ্দের নেই, কাজ নেই, উপার্জনও নেই। রাস্তায় তারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের আটকানো দেখছে! ব্যক্তি-সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঘেঁষাঘেঁষি করে গাড়িকে জরিমানা করা দেখে আনন্দ পাচ্ছে। তাদের আর দোষ কী?
ইউরোকাপ ফুটবলে অনেক দর্শক করোনা সংক্রমিত হয়েও মাঠে খেলা দেখছেন। তারা নাকি টিকাও নেননি! তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে করোনা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। এরা ফুটবল ফ্যান শুধু নয়- ভয়ংকর ‘মব’। পুলিশ ওদেরকে সামলাতে হিমশিম খায়। তাই তাদেরকে মাড়াতে যায় না। তারা সবাই উন্নত দেশের তথাকথিত শিক্ষিত-ভদ্র মানুষ হলে কি হবে।
আমাদের দেশে ১ জুলাই সকালে শহরের এক রেস্টুরেন্টে গাদাগাদি করে মানুষ খাবার খাচ্ছে। কারণ জানতে গিয়ে জানা গেছে, দোকানের দরজা খোলার সাথে খদ্দেররা হুড়মুড় করে ঢুকে সব আসনে বসে পড়েছে। মালিকের লোকজন মার খাওয়ার ভয়ে তাদেরকে সামলাতে পারেনি। তারা সবাই ভদ্রগোছের মানুষ।
একদিকে শিক্ষিত মানুষদের অবহেলা ও উদাসীনতা, অন্যদিকে নানা বৈষম্য প্রপীড়িত অসংখ্য অজ্ঞ, নিম্নআয়ের মানুষদের পেটের দায় সবকিছুর কাছে যেন করোনার সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষেত্র খুবই উর্বর ও সহজ ব্যাপার। সেই সুযোগ নিয়ে করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এখন আরো আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে।
মহান জাতীয় সংসদে নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবার কথা উঠেছে কিন্তু তারা সেকথা এখনও কারো কাছে শোনেনি। সেই খাবার দরিদ্র শ্রমিকরা কখন, কোথায়, কিভাবে পাবে বা আদৌ পাবে কি-না সে তথ্য তাদের জানা নেই। বিধিনিষেধের প্রথমদিন একজন ভিক্ষুক সকালবেলাতেই আমাদের আবাসিক এলাকায় ঢুকে বার বার কলিং বেল টিপছিল। কীভাবে সে ঢুকলো জানতে চাইলে সে জানায়, আজ কঠোর লকডাউন সে জানে না। দারোয়ান দয়া করে তাকে ঢুকতে দিয়েছে। দশটাকা দিলে সে সরাসরি বলল, স্যার চাল কিনতে হবে আমাকে একশ’ টাকা দেন। পরদিন শুক্রবারের অবস্থা ছিল আগের মতই বেগতিক। সংক্রমণের এই ভয়াবহ সময়ে সরাসরি ভিক্ষাদান করাটাই যেন খুব কঠিন কাজ।
গ্রামে গতবছর কেউ করোনাকে পাত্তা দেয়নি। এখন গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর ঘরে ঘরে সর্দ্দি-জ¦রের কথা জানা যাচ্ছে। বেশী আক্রান্তরা হন্যে হয়ে ছুটছেন হাসপাতালে। অনেকের চিকিৎসার টাকা নেই। বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছেন। এরমধ্যে জানা গেল, তারা জীবিকার তাগিদে সাইকেল, মোটর সাইকেল, অটোরিক্সায় চেপে হাটে-বাজারে যাচ্ছেন। অনেকের মুখে মাস্ক নেই। গ্রামে স্বাস্থ্যবিধি উধাও। আইন-শৃংখলা বাহিনীর কেউ তদারকিতে নেই বা তাদেরকে বাইরে যেতে নিষেধ করছেন না।
কঠোর লক্ডাউনে পোশাক কারখানা খোলা। রিক্সা ও খাবারের দোকান খোলা, কাঁচাবাজার খোলা। এর সবকিছুর সাথে নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। এদের অনেকের আইডি কার্ড নেই। মাস্ক কেনার অর্থ নেই। হতদরিদ্র মানুষগুলোর জন্য খাবার সরবরাহের কথা বলা হলেও তা কীভাবে দেয়া হবে বোধগম্য নয়। এদের জন্য তিন/চার কোটি মাস্ক বিতরণ করার কথা বলা হচ্ছে। সেটা সংগ্রহ ও বন্টনের ব্যবস্থাপনার কথা কেউ কোথাও ভালভাবে বলছেন না।
শহরের অলি-গলি ছাড়াও গ্রামে-গঞ্জে, বস্তিতে করোনা সংক্রমণের গতি কমানোর জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে নজরদারি বাড়ানো উচিত। এসময় হাট-বাজার করোনা ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম। সামনে কোরবানীর গরুর হাটে উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত। তা না হলে সারা দেশের গ্রামগুলো কোন কারণে ভারতের গ্রামাঞ্চলের মত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে থাকলে তার ঢেউ কোন শহরকেও ক্ষমা করবে না। রাজপথে টহলদার কর্তৃক বিধিনিষেধ ভঙ্গকারীদেরকে জরিমানা করা দেখে আপ্লুত হবার মত কোন কৌতুহলী জনতা আর ঘরের বাইরে বের হবার সুযোগ নাও পেতে পারে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top