চাপকলে চাপা পড়া জীবন
কামরুল হাসান।।
এবার গ্রামের বাড়িতে এসে টিউবওয়েল দেখে মুখ লাগিয়ে পানি খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। কত দিন এভাবে পানি খাইনি। কিন্তু গিয়ে দেখি কলতলায় অনেক ময়লা। পড়তি বয়স আর বাড়ন্ত শরীর পথ আটকে দিল। পানি খাওয়া আর হলো না।
বাড়ির এই টিউবওয়েলটার জন্ম দেখেছি আমি। সেই সুবাদে সেটা বয়সে আমার চেয়ে ছোট। তবে অব্যবহারের কারণে মনে হয় অশীতিপর। বাড়িতে এখন বিদ্যুৎ চালিত মোটরে পানি ওঠে। সেই পানি পাইপে করে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তাই বুড়ো বটগাছের মতো পুরোনো টিউবওয়েলের দিকে কারও নজর নেই।
স্মৃতির পাতার ধুলাবালি ঝাড়লেই বেরিয়ে পড়ে আমাদের বাড়ির বড় আকারের কুয়াটা। পাড়ার সবাই সেই কুয়া থেকে পানি নিতেন। পরে আব্বার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে টিউবওয়েল আসায় কুয়াটা অচল হয়ে গেল। আমাদের পাড়ায় তখন আর কোনো বাড়িতে টিউবওয়েল ছিল না। পানির জন্য মানুষ ভেঙে পড়ত। পানি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটিও কম ছিল না।
বাড়ির যে ঘরে আমি থাকতাম, তার পাশেই ছিল টিউবওয়েলটি। সারা দিন কল চাপার শব্দ কানে বাজতো। গভীর রাতেও কেউ কেউ পানি নিতে আসতেন। শব্দ পেলেই আমি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতাম। একবার হাড় কাঁপানো শীতে গভীর রাতে কলতলা থেকে পানি তোলার শব্দ। নির্মলেন্দু গুণ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন অব্দি পড়িনি। পড়লে বলতাম, ‘কল ঘরে জলের শব্দ শুনে মনে হলো, এত শীতের রাতে এত জল কার প্রয়োজন’ । এরপর চুপিসারে জানালা খুলে দেখি আমার চাচাতো ভাই এবং তাঁর সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী।
আমাদের স্কুলের পুকুর পাড়েও একটা টিউবওয়েল ছিল। আমরা খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে উঠলে দৌড়ে কলের কাছে যেতাম। তারপর কলের মুখটা হাত দিয়ে চেপে বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর ফাঁকে মুখ লাগিয়ে প্রাণ ভরে পানি খেতাম। আমার পরে গোপেন পাণ্ডে, তারপর মেহেবুব, সুকান্ত সাহা, সবশেষে মইদুল। ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, জাতপাতের ভেদাভেদ নেই। টিউবওয়েল ছিল আমাদের কাছে সাম্যের প্রতীক।
আমাদের এভাবে পানি খেতে দেখে পুকুর পাড় থেকে মেয়ে বন্ধুরা দৌড়ে আসত। একজন এসেই বলত, তোরা যা করছিস সেটা অসভ্যতা। অন্যজন এক পলক দেখে না দেখার ভান করে চলে যেত। কেউ আগ বাড়িয়ে বলত, দে আমি কল ঠেলে দি। আমার এক খালাতো বোন এককাঠি এগিয়ে এসে দরদি গলায় বলত, ভাই তোর জন্য একটা গ্লাস এনে দেব? আমি খুব ভাব নিয়ে বলতাম, না, লাগবে না। কখনো কখনো আমার পানি খেতে ইচ্ছেও করত না, তাও খেতাম।
আসলে আজও আমার কোনো পানির তৃষ্ণা নেই । সব তৃষ্ণা কী শুধু পানের? আমি জানি, কলের হাতলে চাপ দিলেই মাঝ রাতের ডাকাতের মতো আছড়ে পড়বে আমার ছেলেবেলা। যেন, আমি একটি সুপারি গাছের মাথায় বসে দোল খাচ্ছি, আর আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে খেলার সাথিরা । আমার চোখের সামনে আমার স্কুল, পাড়ার বন্ধু, আমার পায়ের নিচে অবিরল ঘাস, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আব্বার ফিরে আসা। তিনি বাড়ি ফিরেই বলবেন, সন্ধ্যা হলো তাও ছেলে–মেয়েরা পড়তে বসেনি? বাড়ির পুরোনো গৃহকর্মী পুকি খালাকে ডেকে মা বলবেন, আজান হলো সাঁঝ বাতিটা দে । মায়ের কথা শুনে ঘরে ঘরে হারিকেন আনতে যাবেন পুকি খালা। এর মধ্যে রাজ্যের ধুলোবালি গায়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসব আমি। আমাকে দেখেই মা রেগে বলবেন, লিস্তি ছেলে কোথাকার...যা গা ধুয়ে আয়। আমি কলতলায় গিয়ে হাতলে চাপ দিয়ে বালতি ভরে নেব। তারপর আপন মনে পানি ঢালতে থাকব। আমার কাণ্ড দেখে গামছা হাতে দৌড়ে আসবেন ছোট মা। আমি কোনো কিছুই না শুনে কলতলা ভাসিয়ে দেব।
আমি জানি, উপচে পড়া পানির তোড়ে ভেসে যাবে দড়িছুট বাছুরের পেছনে ছোটা দুরন্ত গ্রাম্য বালকের জীবন। যে জীবন আমি ফেলে এসেছি বহুদূরে, বহু বছর আগে– শহুরে হয়ে ওঠার মোহে। তবুও ঘাটে বাধা নৌকার মতো দিনভর সে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে। আমিও শক্ত করে দড়িতে গিট দিই, যেন কিছুতেই ছেড়ে যেতে না পারে।
মনে মনে ভাবি, মানুষের বোধহয় কোনো ছেলেবেলা হয় না। আমার খেলার সাথিরাও ঠিক মানুষ নয়, ওরা আসলে আমার ফেলে আসা সময়, মহাকাল। নির্মলেন্দু গুণ ঠিকই বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম’।
সাম্প্রতিক মন্তব্য