logo
news image

ধর্ষণের বিরুদ্ধে ‘স্যোসাল এ্যাকশান’

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
দেশের বহু এলাকায় পর পর চার বার বন্যা হলো। করোনা-বন্যায় বিপর্যস্ত, নাজেহাল মানুষ বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে চলেছে। তার ওপর হঠাৎ করে ধর্ষণ যেন পঞ্চমবারের মত হু হু করা বানের পানির স্রোতের ন্যায় চারদিকে সয়লাব করে করে সুনামী তৈরী করে ফেলেছে।
চারদিকে শোনা যাচ্ছে ধর্ষণের নানা কারণ ও প্রতিকারের পরামর্শ। ধর্ষণের দুর্বার গতি ঠেকাতে রাজপথে নেমে সামাজিক আন্দোলন ও সামাজিক পুনর্জাগরণের কথাও বলছেন কেউ কেউ। মেনে নিচ্ছি, সবার বলা কথা, লেখা, ধর্ষণের কারণ ও প্রতিকারের পরামর্শগুলো কোন না কোনভাবে চলমান ধর্ষণকে সাময়িকভাবে বন্ধ কারার জন্য যথেষ্ট। ধর্ষণের মত সামাজিক ব্যাধি এক ধরনের সংক্রামক রোগ শুধু নয়-এটা একটা মহামারী। কারণ, ধর্ষণ সংঘটনের মত খোঁচাদানকারী উপাদান চারদিকে বাধাহীনভাবে অতি সহজলভ্য উপায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে দিয়ে শুধু চিৎকার হা-হুতাশ করে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না।
ধর্ষণ শুধু দৈহিক নয়, একটি জৈব-মানসিক অপরাধও বটে। যৌবনপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের বয়স দেশের আইনগত পরিধি অনুযায়ী যথেষ্ট হোক বা নাহোক জৈবিক কারণে মানুষ এজন্য প্রেষিত আচরণ প্রকাশ করতে চায়। এই প্রেষিত আচরণের সাথে সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় ও আরো অন্যান্য যোগসূত্র মিলে একটি ‘স্যোসাল বন্ড’ তৈরীর মাধ্যমে পৃথিবীর একেক সমাজ একেকভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন, যুদ্ধ ও ডাকাতি ছাড়া মানুষের অভাব তাড়ানোর জন্য জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কর্মসূচি শুরুর আগের দিনগুলোতে এই উপমহাদেশে এমন গণধর্ষনের কথা কোথাও লিখিত নেই। আবার ইউরোপের যেসব দেশে বয়:প্রাপ্ত হলে যৌনতা নিয়ে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই সেখানে বিয়ে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আবার সেখানে ধর্ষণ সংঘটনের ঘটনা ও মামলার হার খুব কম। একটি ‘স্যোসাল বন্ড’ সেসব দেশে আইনি হস্তেেক্ষপ পর্যন্ত না গড়াতে বহুলাংশে সহায়তা করে থাকে। কারণ, তাদের দেশের মানুষ এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রচলিত আইনকে শ্রদ্ধা করে। নৈতিকতাকে কখনই ক্ষুন্ন হতে দেয় না, কারো প্রতি কখনোই অমানবিক হতে দেয় না। ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো একটি মজবুত খুঁটির উপর টিকে থাকে।
 যেমন, কোন কল্যাণরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল বা পরিধির মধ্যে ইন্টারনেটে যৌনতা সম্বলিত ছবি, ভিডিও বা অশ্লীলতার সাইটে ঢোকার উপায় নেই। তারা উপযুক্ত ফায়ারওয়াল দিয়ে সেসব এলাকায় অশ্লীলতা ঢোকার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার জন্য শুধুমাত্র লাইব্রেরী বা শিক্ষা সংক্রান্ত উপকরণগুলোতে এ্যাকসেস্ পেতে পারে। আমাদের দেশে সেটা উল্টো। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেটের কোন নিষিদ্ধ পেজে নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা সারারাত না ঘুমিয়ে বিনা খরচে অবাধ এডাল্ট নেটে বিচরণ করতে পারে। এমনকি ক্লাশে বসেও তা করতে পারে।
এছাড়া আবাসিক এলাকাতেও বাচ্চাদের জন্য আলাদা তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ফলে যার যখন যে কাজ করার কথা আমরা তাকে ভিন্নকাজ, অন্যায়ভাবে সেগুলো চর্চা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। অল্পবয়স্ক শিশু, কিশোরদের হাতে দামী ডিভাইস দিয়ে অবাধ যৌনাচারের ছবির দিগন্ত উন্মোচন করে রেখেছি। এ ব্যাপারে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কারো কোন কঠিন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বরং যারা যত বেশী বিত্তশালী ও রাজনৈতিকভাবে নিজেকে ক্ষমতাধর মনে করে তাদের পরিবারে এসব কাজে নিয়ন্ত্রণহীনতা তত বেশী। যেমন, ক’বছর আগে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সন্তানকে তার গ্যাংসহ ধর্ষণের অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূ গণধর্ষণের ঘটনায় বিত্তশালী ঘরের নাদুসনুদুস সুন্দর চেহারার ছেলেরা জড়িত বলে সংবাদে এসেছে।
অবৈধ অর্থবিত্ত ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আমাদের দেশের ‘স্যোসাল বন্ড’-কে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। গ্যাংবাজদের হুমকি, অন্যায় করেও রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে গলা ফুলিয়ে চলার আক্রোশ আমাদের সমাজকে এক সীমাহীন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আজকাল সামাজিক প্রতিরোধ না থাকায় ভাল পরিবারগুলো বাইরের হীন পরিবেশ নিয়ে জনসমক্ষে কথা বলতে ভয় ও লজ্জা পায়। তারা চাপা ক্ষোভ ও কান্না নিয়ে একা চুপটি মেরে থাকতে ভালবাসে। কারণ, কোন ব্যাক্তি বা ভাল পরিবার আক্রান্ত হলে তাদের সহানুভূতি দিতে আগের মত এলাকাবাসীগণ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা অনেকে  নিজেরাই অপরাধে জর্জরিত হয়ে বিচারের সন্মুখিন হওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই ক’দিন ধরে দিকে দিকে বাঁধভাঙ্গা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমে গেছে অসহায় মানুষ। আজকের দু’টি বিখ্যাত দৈনিকে লেখা হয়েছে- “আমরা যেন ধর্ষক তৈরীর কারণ না হই” অথবা, “নিপীড়কদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ধিক্কার”, “ধর্ষককে ফাঁসি দিতে হবে অথবা খোজা করে দিতে হবে।” আমাদের দেশে রাজপথে আন্দোলন হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আন্দোলনের ইতিবাচক ফল কম। সেফল সচরাচর আলোর মুখ দেখে না। ফলে দেশে ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক সামাজিক সমস্যা কমে না বরং নানামুখী প্রশয় পেয়ে আরো বেড়ে চলে।
এছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্রশাসনিক ঘুষ-দুর্নীতির প্রবাহ থাকায় অপরাধের সঠিক বিচার হয় না- হয় না দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি। মানুষ বিচার চেয়ে হতাশ হয়ে নিরুৎসাহিত হয়। ফলে ধর্ষণের মত বিষয় সৃষ্টি হলে সামাজিক লজ্জা ও সামাজিক ঘৃণা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কার্যত: লাগামহীন ধর্ষণের মত ঘটনা সৃষ্টি হতেই থাকে।
বর্তমান ধর্ষণের প্রধান অনুষঙ্গ উত্তেজক মাদকদ্রব্য। সীমান্ত দিয়ে যৌন উত্তেজক মাদকদ্রব্য সারা দিন-রাত দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে। মাদকের রমরমা ব্যবসা অদৃশ্য কারণে জিইয়ে থেকে আইন ও নৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। ধর্ষকদেরকে পকেটে উত্তেজক বড়ি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ানোর সংবাদ পাওয়া গেছে।
সারাদেশ ভয়ানকভাবে যৌন উত্তেজক মাদক দ্রব্যে ভরে গেছে। উঠতি বয়সের সবার হাতে হাতে মুঠোফোনে মিনি পর্নোগ্রাফি প্রায় সারাক্ষণ অন করাই থাকে। ঘরে-ঘরে, অফিসের টেবিলে, নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ অনলাইনে চলছে অশ্লীল ছবি। করোনার সময় অনলাইন শিক্ষালাভের নামে এসব ফায়ারওয়ালহীন যৌন উত্তেজক উপাদান হাতে তুলে দিয়ে উঠতি কিশোর-তরুণদেরকে সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তা চেতনায় বেড়ে উঠা থেকে বহুদুরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ওদেরকে সারাদিন হাতে হাতে পর্ণোসম্বলিত ডিভাইস বহন ও মাদক সেবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে ঠেকিয়ে রাখার জন্য শুধু রাজপথে আন্দোলন করে কাজ হবে না। এজন্য নিখুঁতভাবে অগ্রসর হবার বিকল্প নেই। গভীরভাবে সমস্যার রুট জানার জন্য পেশাদার সমাজকর্মের একটি স্তর হলো সামাজিক আন্দোলন। এর পরবতী গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো ‘সামাজিক এ্যাকশন’ বা যথাযথভাকে কার্যক্রম গ্রহণ করা। ধর্ষণ বন্ধ করার আন্দোলনকে অর্থবহ করার জন্য যথাযথ এ্যাকশন কর্মসূচিতে নামতে হবে। সেই এ্যাকশন হতে হবে সার্বক্ষণিক হাতে থাকা মুঠোফোনের নীলছবির বিরুদ্ধে, পকেটে বা সংগে থাকা উত্তেজক ইয়াবা অথবা যে কোন যৌন উত্তেজক বড়ি রাখার বিরুদ্ধে, সেবাদানকারীদের অনৈতিক ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
এছাড়া পড়ার টেবিলে বা অফিসের টেবিলে থাকা পর্ণোগ্রাফি বন্ধে শীঘ্র নিজস্ব গেটওয়ে ও কার্যকরী ফায়ারওয়াল চালু করতে হবে। এজন্য আইসিটি মন্ত্রণালয়কে নীতিমালা তৈরী করে সামাজিক এ্যাকশনের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে তার নিয়ন্ত্রণ নিতে দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকতে হবে। তবেই হয়তো মাদক প্রবাহ বন্ধ হবে ও তার সুফল হিসেবে সমাজে ধর্ষণ কমতে পারে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য