logo
news image

সবই এখন সুখস্মৃতি

এ কে আজাদ সেন্টু
শরৎ সুন্দরী থেকে শ্রী সুন্দরী সবই এখন স্মৃতি। হয়তো একদিন এ লেখাও হবে স্মৃতি। এই তো জীবন! সে তো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে প্রখর হওয়া ভোরের প্রথম আলোকরশ্মি কিংবা শীতের রাতে টিনের চালের টুপ-টাপ শব্দ, যেমন কেউ সারাদিন পেট পুড়ে খায়, আবার কেউ না খেয়েই সারা রাত ঘুমাই! এইতো জীবন। আসলে পৃথিবীটা বড়ই বৈচিত্র্যময়। সদ্য বিয়ের পিড়িতে বসা নববধূটি যেমন ‘জীবনটাকে সুন্দর ভাবে সাজানোর প্রত্যাশায় মনের মাঝে কতনা চাওয়া কত ব্যস্ততা। এর মাঝেও পেছনে ফেলে আসা মুহূর্তগুলোর জন্য একবার হলেও সে পিছনে তাকাই আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করে স্মৃতির আকাশে সাজিয়ে বসে থাকা অপেক্ষমান স্মৃতিগুলোকে। ছোট্ট বেলায় একটু আঘাতে কেঁদে ফেলতাম, আর আজ বড় হয়ে ভাঙ্গা হৃদয় নিয়েও হাসি। হ্যাঁ হাসতে হয়! আগে একজন বন্ধুর জন্য আমরা প্রাণ দেবার শপথ নিতাম অনাশে। কিন্তু আজ ব্যস্ত জীবনে অনেক বন্ধুর কথা মনে-ই পড়েনা-অনেক বন্ধুর! আর সেই ছোট্ট বেলায় একটুতেই ঝগড়া, একটুতেই যা ছিলাম তাই, আবার মূহুর্তেই এক সাথে খেলাধূলা। এখন অল্প কথাতেই সর্ম্পকটাই শেষ হয়ে যায়। যা দু:খজনক হলেও সত্য। যেটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। একটু ভাবুন- সেই ----তখন, আর এই এখন.. কতই-না --- তফাৎ !
ইচ্ছে ছিল প্রবল। সেনা বাহিনীর অফিসার হতে হবে। সেই ইচ্ছে থেকেই মনের আকাশে আঁখতে থাকি স্বপ্নের ছবি। যখন আমি সবে মাত্র পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ঠিক তখন থেকেই একটি বিশেষ টানে আমি নিয়মিত লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আসতে থাকি। প্রথম প্রথম অনেক দূর থেকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম। এক পর্যয়ে একটু সাহস করে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে দেখতে আগ্রহটা ক্রমেই বাড়ে। হ্যাঁ আমি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বি.এন.সি.সি)’র কথা বলছি- শ্রী সুন্দরী পাইলটের নামে আর বি.এন.সি.সি’র টানেই হয়তো প্রতি সপ্তাহে যে দুদিন প্রশিক্ষন চলতো সেই দুদিনের একদিন ভোরে আর দিন বিকেলে মাঠে হাজির থাকার চেষ্টা করতাম। বি.এন.সি.সি’র প্রশিক্ষন কর্মসূচি দেখতে আসতাম।
আসলে আমার এই ইচ্ছের পিছনে যে মানুষটি উৎসাহ জুগিয়েছেন সেই মানুষটি আজ আমাদের মাঝে আর নেই। তিনি আমার বাবা। তিনি প্রায়ই বলতেন- যে কোন সুশিক্ষা অর্জনে লাভ না হলেও ক্ষতি হবেনা। পঞ্চম শ্রেনী পাশ করে ভর্তি হলাম লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর বি.এন.সি.সিতে ভর্তির জন্য নূরুল ইসলাম বাসার স্যারে নিকট ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। স্যার বললেন মেডিকেলে ফিট হলে চলবে। পরবর্তীতে মেডিকেলে চেক আপের পর বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বি.এন.সি.সি) তে ভর্তি হই। প্রতি নিয়ত প্রশিক্ষনে অংশ নিয়ে নিজেকে সফল হতে কঠোর পরিশ্রম করতাম। সেই সময় নূরুল ইসলাম বাশার স্যারই বি.এন.সি.সি ও স্কাউট পরিচালনা করতেন। তিনিই তখন লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের (বি.এন.সি.সি) টিচার আন্ডার অফিসার ছিলেন। স্যারের একটি বিষয় খুব মনে পড়ে-কেউ যদি ফুলহাতা সার্টের বোতাম খুলে রাখতো বা হাতা ভাঁজ করে পরতো তাহেলে তাকে তিনি উচিত শিক্ষা দিতেন। বলতেন যদি বোতাম খুলে বা হাতা ভাঁজ করেই সার্ট পরবে তাহলে বোতাম লাগিয়েছো কেন, ফুল হাতা পরেছো কেন ? কিন্তু এমন কথার মাঝেই হটাৎ একদিন শুনি প্রিয় স্যার স্কুল থেকে বিদায় নিয়েছেন। পরবর্তীতে (বি.এন.সি.সি) টিচার আন্ডার অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন প্রক্তন প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম স্যার, বর্তমান প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার সরকার স্যার, সহকারী শিক্ষক শামসুল স্যার, সিরাজুল ইসলাম স্যারসহ অনেক শিক্ষক। যা আজ এখন সবই স্মৃতি।
প্রশিক্ষন কালে সময়ের আগেই মাঠে হাজির হতে হতো। যখন ঘুম থেকে উঠে মাঠে আসতাম তখন সেই ভোর যে ভোরে কাকও ডাকেনা হয়তো তখনও জোনাকিরাও ঘুমোতে যায়না । মূলত ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে ছুটতে হতো প্রশিক্ষনে। কখনো খাকিড্রেস, কখনো সাদা জুতা-মোজা, সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ৩২ জন ক্যাডেট যখন রাস্তায় মার্চ করতো তখন মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখতো। তখন ভিশন ভাল লাগতো। এরপর  ১৯৮৮ সালে ঢাকায় এক মাস ব্যাপী ক্যাম্প হয়েছিল এরশাদ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে। মনে পড়ে সেখানে একমাস ব্যাপী প্রশিক্ষনে অংশ নিয়ে বারেক, সাজু, শামীম, রহমান, অলক কুমার ভক্ত, সাইদুর সহ আমরা ৮ জন ক্যাডেট সফলতার সাথে প্রশিক্ষন সমাপ্ত করি। রাজশাহীতে ক্যাম্প হয়েছে, সেই ক্যাম্পেও অংশ নিয়েছি। এই প্রতিষ্ঠানে বি.এন.সি.সি’র প্রশিক্ষন প্রাপ্ত অনেক ক্যাডেট সনদ নিয়ে সেনা, নৌ ও পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী করছেন। অনেকে অবসর নিয়েছেন।
মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে চা-বিস্কুট পরিবেশন: ১৯৯০ সালে বি.এন.সি.সি ও স্কাউট সদস্যদের নিয়ে একটি দল রোড মার্চ করতে করতে বিলমাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যায়। সেখানে স্কাউট সদস্যদের নিয়ে “কাঠি সামালোরে ভাই -কাঠি সামালো, চোখে মুখে লেগে-গেলে ভাই --” গান পরিবেশন শেষে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যেই চা-বিস্কুট রেডি করে উপস্থিত সকলের মাঝে পরিবেশন করি। সেই দিন উপস্থিত ছিলেন বিলমাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলাম স্যার, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ফিল্ডম্যান মোহরকয়া গ্রামের প্রয়াত নায়েব উদ্দীন, বিলমাড়ীয়া স্কুলের শিক্ষক কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সহ অনেকেই। সেই দিন শামসুল স্যারের নেতৃত্বে আমি (ক্যাডেট অধিনায়ক -বি.এন.সি.সি) জালাল উদ্দিন বাবু (স্কাউট দলপতি), গণেশ চন্দ্র (বাদ্যযন্ত্র পরিচালক)। এর মাঝে অনেকই এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। আমাদেরও একদিন তাদের পথ ধরে বিদায় নিতে হবে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু হাজার বছর স্বগৌরবে দাড়িয়ে থাকবে এই প্রতিষ্ঠান। কৃতি শিক্ষার্থীসহ সকলের প্রতি অনুরোধ, যে যে অবস্থানেই থাকেননা কেন প্রিয় প্রতিষ্ঠানের যেন আমরা একটু খোঁজ রাখি।
২০১৩ সালে আমি যখন স্কুলের অভিভাবক। অনেকের অনুপ্রেরণায় অংশ গ্রহন করি ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে। আমার প্রিয় শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্খীসহ সকলের আন্তরিক সহযোগীতায় প্রত্যক্ষ ভোটে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই। এরপরই এই প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্র লালপুরের কৃতিসন্তান (সার্ধশত বর্ষ উৎসব উদযাপন কমিটির প্রধান উপদেষ্টা) এস.পি আলমগীর কবির পরাগ ভাইয়ের দিক নির্দেশনায় শুরু হয় শতবর্ষ উৎসব পালনের প্রস্তুতি। ব্যাপক উৎসাহে এগিয়ে যাচ্ছিল শতবর্ষ উৎসব উদযাপনের কাজ। পরবর্তীতে যা দেশের রাজনৈতিক কারণে স্থগিত হয়ে যায়। এর মধ্যে পার হয়ে যায় প্রায় সাতটি বছর। ইতি মধ্যে দেশের ঐতিহ্যবাহী অতি প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় অতিক্রম করেছে ১৫০ বছর। ২০১৯ সালের ম্যানেজিং কমিটি ও সার্ধশতবর্ষ উৎসব উদযাপন কমিটির নেতৃত্বে সার্ধশত বর্ষ উৎসবের আয়োজন আবারো এগিয়ে চলছে। যা সফল হতে চলেছে, এবং সফল হবেই। ১৮৬৭ থেকে ২০২০ সালের মতো হয়তো কোন একদিন এই লেখাও হবে স্মৃতি । দেখা হচ্ছে ১১ জানুয়ারী ২০২০ সালে। সেই দিন তৈরী হবে আরো অনেক দৃশ্য নিয়ে নতুন কোন ইতিহাস।
আজ মনের মাঝে বড়ই কষ্ট নিয়ে বলতে হচ্ছে এমন দিনে ঐতিহ্যবাহী আমাদের এই প্রিয় বিদ্যালয়টি সকল যোগ্যতা থাকতেও সরকারীকরণ হয়নি। আগের মতো নেই স্কাউটের গতি, বাশার স্যারের মতো বিদায় নিয়েছে আমাদের প্রিয় বি.এন.সি.সি। যা সবই এখন সুখস্মৃতি।
* এ কে আজাদ সেন্টু: সাংবাদিক, প্রাক্তন ছাত্র, ক্যাডেট অধিনায়ক (বি.এন.সি.সি)।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top