logo
news image

কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কিশোরনীতি

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
সম্প্রতি কিশোর গ্যাং দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে সামাজিক শান্তি বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রিফাত হত্যাকাণ্ডে নয়নবন্ড ০০৭-এর নাম উঠে আসার পর থেকে গণমাধ্যম এ বিষয়ে সরব হয়েছে এবং পুলিশও নড়েচড়ে বসেছে।
যদিও কিশোর গ্যাং নামক ইস্যুটি আমরা নতুন শুনছি কিন্তু এর ইতিহাস অনেক পুরনো।
এক সময় সামাজিক ট্যাবু ধারণার বশবর্তী হয়ে হাতে কপালে উল্কি, শরীরে ট্যাটু, মাথায় কখনো বাহারি ছাঁট, কখনো ঝাঁকড়া চুল, নির্দিষ্ট রঙের হ্যাট-গেঞ্জি-জার্সি পড়ে একদল কিশোর-তরুণ নিজেদের জাহির করার জন্য রাস্তায় নেমে পড়তো। সাধারণত, মোটরবাইক তাদের পছন্দের বাহন। এখন তারা উচ্চগতির মোটরগাড়িও ব্যবহার করে। এরা উঠতি সমবয়সী, সহপাঠী, খেলার সাথী, বন্ধু-বান্ধব মিলে গড়ে তুলে গ্যাং বা বিশেষ গ্রুপ।
কোনো দাবি আদায় ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের অন্যায় আধিপত্য জাহির করা তাদের উদ্দেশ্য। নিজেদের কাজকে এরা সবসময় ন্যায় বলে মনে করে এবং স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভায়োলেন্স সৃষ্টি করতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না।
এরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষকে ভয় দেখায়। মানুষ তাদের নাম শুনলে শিউরে ওঠে।
এরা অনেকে পরবর্তীতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হাতিয়ার হিসেবে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে মফিয়া-ডন হিসেবে দেশে বিদেশে খ্যাতিমান হওয়ার পথ খুঁজে পায়। কেউ কেউ নির্বাচন করে ও নেতাও হয়ে যায়।
কিশোর গ্যাং এক সময় বড় হয়ে স্ট্রীট গ্যাং-এ পরিণত হয় ও বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বড় বড় গ্যাংগুলোর ইতিহাস ঘাঁটলে এমন তথ্যই উঠে আসে।
একসময় Intoxicants র প্রসার ও সন্ত্রাস বাড়তে থাকলে ধর্মীয় অপবিত্রতা ও মন্দের প্রতিবাদ করার প্রত্যয় থেকে শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে কিছু ভালো মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষিতে কিছু মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে এর বিরোধী শক্তি গজিয়ে ওঠে ও ১৬৭০ সালে ‘ব্লাডি ফুল’ বা ‘একদম বোকা’ নামক ধারণা জন্ম নেয়। ‘ব্লাডি ফুল’ বলে তারা সহজ-সরল মানুষকে টিজ করতো। এটাকেই টিন এজাররা বেশি ব্যবহার করতো।
সতের শতাব্দীতে লন্ডনে মাইমস্স, বাগল্স ও জেড বয়েজরা সংগঠিত সন্ত্রাসী কিশোর গ্যাং ছিল।
১৭৮৩ সালে অ্যামেরিকান রেভ্যুলুশনের সময় পূর্ব আমেরিকার দ্বীপগুলোতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অভিবাসী গ্রামীণ জনগণের মধ্যে কিশোর গ্যাং সংগঠিত হয়ে উঠেছিল।
কয়েক বছর পর ১৮২০ সালে নিউইয়র্ক সিটির আশেপাশের সাবার্ভ এলাকায় 'ফরটি থিভস্' বা 'চল্লিশ চোর' নামে পৃথিবীর প্রথম স্ট্রীট গ্যাং আত্মপ্রকাশ করে। এরা সহিংস কাজে জড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে ড্রাগ বাণিজ্য শুরু হলে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
আ্যাপাচি গ্যাংস্টার ১৯০৪ সালে প্যারিসে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সংবাদের শিরোনাম হয়। এরপর ১৯১২ সালে ‘আন্তর্জাতিক আফিম কনভেনশন’ অনুষ্ঠিত হয় ও ১৯১৯ সালে নিয়ন্ত্রণমূলক ‘ভলস্টিড এ্যাক্ট’ প্রণীত হয়।
১৯২০ সালে শিকাগো শহরে এক হাজারেরও বেশি গ্যাং ছিল। ড্রাগ ট্রাফিকিং করাই তাদের মূল কাজ ছিল।
১৯৭০ এর দশকে আমেরিকার লসএঞ্জেস্-এ এম-১৩ নামে ক্রিমিনাল গ্যাং জন্মলাভ করে। মূলত: সালভাদর থেকে আগত অভিবাসীরা স্থানীয়দের দ্বারা নির্যাতিত হতো। এদের রক্ষাকল্পে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভয়ংকর এম-১৩ ক্রিমিনাল গ্যাং সৃষ্টি হয়েছিল।
এভাবে ইউরোপের নানা দেশে গ্যাংগুলোর নানা নাম- মাফিয়া, জ্যামাইকার শাওয়ার পোজ, ক্রিয়াস, আরিয়ান ব্রাদারহুড, পেনিমব, চাইনিজ হংকং এর ত্রিয়াদ, ব্লাক সামুরাই, জাপানের ইয়াজুদা, ইন্ডিয়ান থাগ, আমেরিকার বাউরী বয়েজ, ইত্যাদি গ্যাং জন্মলাভ করে।
তবে উন্নত দেশে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় কিশোর অপরাধজনিত সমস্যা সহজে মোকাবেলা করে ফেলা হয়। এজন্য তারা সতর্ক দৃষ্টি রেখে ওদের কল্যাণে জরুরিভাবে “কিশোর নীতি” প্রণয়ন করে সামাজিক ভাঙ্গন রোধ করতে পেরেছে।
আমাদের দেশে দুর্বল আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরি বা কর্মসংস্থানের অভাব অভিভাবকদের সাথে স্কুলগামী বাচ্চাদেরও চরম হতাশ করে তোলে। ঘিঞ্জি শহর ও শহরতলীর কষ্টকর জীবন যাপন, পার্ক ও খেলার মাঠ ধ্বংস করা, চারদিকে মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি, সহজলভ্য পর্নোগ্রাফি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ওপর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের অত্যাচার, মেধাহীন শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের অদক্ষতা, পাড়া-মহল্লায় দলাদলি-ঝগড়া, কোন্দল, মারামারি, পারিবারিক উদাসীনতা ও ভাল জিপিএর জন্য অনৈতিক চাপ, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর চরম পক্ষপাতিত্ব ও নির্যাতন, বন্ধু ও খেলার সাথীর বাবাদের অসৎ আয়, বাবার বেতনের তুলনায় বেশি সম্পদ ইত্যাদি আমাদের শিশু-কিশোরদের অসহিষ্ণু করে তোলে।
চারদিকে অনৈতিকতা ও অব্যবস্থাপনা দেখে কিশোর মন বিগড়ে যায়। সমাজ, পরিবেশ, পরিবার এমনকি বিদ্যালয় থেকেও তারা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের কিশোর গ্যাংগুলো দেশের অনেক বিত্তশালী পরিবার থেকেও সৃষ্টি হচ্ছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকের মধ্যে নৈতিক দারিদ্র বড় দারিদ্র হিসেবে দেখা দিয়েছে।  ইতিবাচক মূল্যবোধ যেমন সততা যেন শুধু মুখের ও মিডিয়ার বুলি হিসেবে শোনানো হয়। আর নেতিবাচক মূল্যবোধ যেমন দুর্নীতির চর্চা আমাদের নিত্যদিনের বিষয়। এই সব সামাজিক ভণিতা ও বৈপরীত্য শিশু কিশোরদের নৈতিকতা ভোতা করে ফেলে।
আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য পিয়ার গ্রুপ সংশ্লিষ্ট সংগঠন নেই, নেই কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা। কিশোর অপরাধীরা সংশোধনের সুযোগ তেমন একটা পায় না বললেই চলে। কারণ এদের জন্য সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অপ্রতুল।
আমাদের দেশে ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশু নীতি প্রণীত হয়েছিল। যেটা ২০১১ সালে সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।
২০১১ সালের জাতীয় শিশু নীতির ১২ নং ধারায় শিশুদের সমস্যা নিয়ে গবেষণা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-“শিশু বিষয়ক কার্যক্রমের উত্তরোত্তর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা, চলমান উদ্যোগসমূহের যথাযথ পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়নের নিমিত্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”  কিন্তু কিশোরদের জন্য আলাদা করে কোনো কিছু বলা হয়নি।
আমাদের সতর্ক হতে হবে যে- কিশোর-তরুণরা একজন দুর্নীতিপরায়ণ বাবা-মা বা অভিভাবকের কথা উপেক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক। একজন কর্কশ, বদমেজাজি ও অদক্ষ শিক্ষকের পড়া বুঝতে চাইবে না এটাই নিয়ম। ওরা সবাই দেশ ছেড়ে মরণ সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফিরে আসত চাইবে না, আর দেশে থেকে কিশোর সন্ত্রাসী গ্যাং গঠন করে সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি করবে-এটা আমাদের সবার সমষ্টিগত মাথাব্যথা।
তাই কিশোর-তরুণরা যাতে আমাদের অবহেলার কারণে বখে গিয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী গ্যাং-এর সাথে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য তাদের ওপর যত্নের সাথে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ওদের কল্যাণে জরুরিভাবে “কিশোর নীতি” প্রণয়ন করতে হবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top