logo
news image

১৫ আগস্টে রুখে দাঁড়ান সিদ্দিকুর রহমান

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল, সময় ভোর ৫টা ৪০মিনিট। ঘাতকের ২৮টি গুলিতে ৩২ নম্বরের বাড়ীতে সিড়িতে লুটিয়ে পড়লেন বাঙ্গালী জাতির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সফেদ পাঞ্জাবী মুহুর্তে হয়ে গেল রক্তে লাল। বুকের রুধিরে সাদা পাঞ্জাবীর ওপর গোলাকার বৃত্ত। ঠিক যেন তার জন্মভূমির সবুজের জমিনের উপর লাল রক্তের বৃত্ত। কি আশ্চর্য মিল!
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার ছিল পাকিস্তান দিবস। এই দিনের রাতটিকে বেছে নিল ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্যে। হাই কমান্ড থেকে করা হলো সার্বিক সহযোগিতা। আগ থেকেই প্রস্তুতি। পেন্টাগনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশেষ নিমন্ত্রণে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামান বিদেশে গেছেন। জানতেও পারেননি কি অজ্ঞাতসারে জঘন্য এক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাকে বিদেশে পাঠানো হলো। আর্টিলারী ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার কর্নেল আনোয়ার হোসেন স্টেশনে নেই। তাকে ডেপুটেশনে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা সেলে পাঠানো হলো। আর্টিলারীর দায়িত্ব ভার দেয়া হলো মেজর রশিদের ওপর। ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল আবদুল মোমেনকে ছুটিতে পাঠিয়ে এ বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হলো মেজর ফারুকের উপর। ট্রেনিং মহড়ার নামে দুই-ভায়রা ফারুক ও রশিদ ট্যাংক, কামান নিয়ে গেলেন কুর্মিটোলার নতুন বিমান বন্দরে। যেখানে মেজর ডালিম, মেজর মহিউদ্দিন প্রমুখ অবসরপ্রাপ্ত ও ক্ষুব্ধ সেনা অফিসারদের জড়ো করা হয়। রাত তিনটার দিকে সব প্রোগ্রামই চুড়ান্ত হয়ে যায়। মিশরের তৎকালিন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত থেকে উপহার পাওয়া ২৮টি ট্যাংক নিয়ে মহড়ার বাহনা করে ফারুক যাত্রা করলো। শুনতে খুব অদ্ভুত শোনালেও সত্য, সেই ট্যাংকের ভেতরে কোন গোলাবারুদ ছিল না। স্রেফ কয়েকটা ডামি ট্যাংক শহরময় ঘুরে বেড়ালো আর রক্ষীবাহিনীসহ সকল বাহিনী সেই ট্যাংকের ভয়েই সিঁটিয়ে থাকল! সাহসই পেল না বেরোতে! কি বিচিত্র!
সে রাতে নরকের কৃষ্ণতম গহবর থেকে উঠে আসা হায়েনাগুলো যখন অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্র নিয়ে কেড়ে নিতে এসেছিলো জাতির পিতার জীবন, তখন একটা লোক তার সাদামাটা সার্ভিস রিভলবার নিয়ে একাই রূখে দাঁড়িয়েছিল তাদের বিরূদ্ধে।
ভদ্রলোকের নাম এএসআই সিদ্দিকুর রহমান। স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ।
১৫ আগস্ট রাত পেরিয়ে যখন ভোর প্রায়, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছে, ঠিক তখনই যেন নরক ভেঙ্গে পড়লো। ঘাতকের দল মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে এলো, কিন্তু প্রথমেই তারা প্রবল বাধা পেল ফটকে। প্রবল গুলিবর্ষণে কেঁপে উঠছে চারিদিক, সে তুলনায় সামান্য অস্ত্র সম্বল করেও দমলেন না রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন অকুতোভয় সৈনিক। বরং প্রধান ফটকে অবস্থান নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললেন তারা। সে মুহুর্তে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশনায় শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে প্রাণ দিয়েছেন দুই বীর, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই সিদ্দিকুর রহমান ও সিপাহি শামসুল হক। তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ যেখানে আক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে কোন উদ্যোগ না নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিচ্ছেন যে, “ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্যাট হাউজ”, ঠিক সে মুহুর্তে আরেক বীর কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ছুটে আসছিলেন, পথিমধ্যে ঘাতকেরা তাকেও নির্বিচার ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ঘাতকেরা। এই তিন বীরই একমাত্র সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্য লড়ে জীবন দিয়েছিলেন।
কিন্তু এর মধ্যে এএসআই সিদ্দিকুরের গল্পটা একেবারেই আলাদা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম, আব্দুর রহমান শেখ (রমা), মো. সেলিম (আব্দুল) ও হাবিলদার (অব.) মো. কুদ্দুস শিকদারের দেওয়া সাক্ষ্য থেকে এএসআই সিদ্দিকুর রহমানের বীরত্বের বিবরণ পাওয়া গেছে। সাক্ষ্যে তাঁরা সিদ্দিককে পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য বলে জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য মতে, ঘটনার রাতে সিদ্দিক অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ফটকে দায়িত্বরত ছিলেন। ভোরে খুনিরা গুলিবর্ষণ শুরু করলে তাঁরা কয়েকজন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তবে ভারী অস্ত্রের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাড়ির বারান্দায় এসে তাঁদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছো?’ এরপর বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’
এ সময় শেখ কামালের সাথে প্রতিরোধে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান। সঙ্গীদের অনুসরণ করেন সিদ্দিকও। কিন্তু সে সময়ই ঘাতকেরা ভেতরে ঢুকে সবার সামনে শেখ কামালকে গুলি করে। এরপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা অস্ত্রের মুখে সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর আদেশ দেয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে মহিতুল, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্যসহ (এএসআই সিদ্দিকুর) অন্য সদস্যদের সারি করে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু সিদ্দিকুর লড়তে চাইলেন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও। ফলে খুনীদের ব্রাশফায়ারে প্রাণ দেন সিদ্দিকুর। পিস্তলটা তখনো তার হাতে ধরা!
অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, ইতিহাসে এই বীরের নাম নেই কোথাও। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁর একটি ছবিও। কেউ দিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও একটা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই তার। মৃত্যুর আগে স্ত্রী ফিরোজা বেগম ও দুই সন্তানের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি এএসআই সিদ্দিক। তাই কিছু না বোঝার বয়সেই বাবাকে হারিয়ে কঠিন জীবনযুদ্ধে নামতে হয় তাঁর দুই ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ও মাহফুজুর রহমানকে। স্বামীর মৃত্যুর ১৭ বছর পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ফিরোজা বেগম।
তার চেয়েও আশ্চর্যের কথা হলো পুলিশ সদর দপ্তর ও এসবিতে খোঁজ নিয়ে সিদ্দিকের ছবি এবং বিস্তারিত ঠিকানা পাওয়া যায়নি। সেখানে শুধু গ্রামের ঠিকানা আছে। সে অনুযায়ী, ১৯৬১ সালে পুলিশে যোগদানকারী সিদ্দিকের বাবার নাম হামিদ আলী। বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং থানার ময়নামতির ঝুমুর গ্রামে। স্বজনদের কাছেও মেলেনি সিদ্দিকের একটি ছবি।
তবে ঘটনার ২৩ বছর পর, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সিদ্দিকের সন্তানদের হাতে দুই লাখ টাকার অনুদান তুলে দেয়। আর ২০১২ সালে পুলিশ সপ্তাহে এএসআই সিদ্দিককে মরণোত্তর বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম-সাহসিকতা) দেওয়া হয়। ওই সনদে বলা হয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় তিনজন বীর প্রতিরোধে এগিয়ে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তাঁরা হলেন কর্নেল জামিল, এএসআই সিদ্দিকুর রহমান এবং সিপাহি শামসুল হক।
এএসআই সিদ্দিকুর রহমানের দুই ছেলে পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর মিরপুরের ২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের এভিনিউ ২/২-এর বাড়িতে। ছোট ছেলে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল চার বছর, বড় ভাই মোস্তাফিজের বয়স ছিল ছয়। বাবার মৃত্যুর পর মা ফিরোজা বেগম আমাদের নিয়ে বুড়িচংয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। মিরপুরের বাড়িটি থাকে এক আত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে। অনেক কষ্টে আমাদের দুই ভাইকে লেখাপড়া করান মা। ১৯৯২ সালে মিরপুরের বাড়িটি বেদখল হওয়ার উপক্রম হলে মা আমাদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। ওই বছরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। আজ পর্যন্ত সরকারি সহযোগিতা বলতে পেয়েছি দুই লাখ টাকা, আর বাবাকে দেওয়া পুলিশ পদকের সম্মান। ‘
মাহফুজ বলেন, ‘বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর সময় আমরা ছোট থাকায় কোথাও তাঁর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি। তাঁর একটি ছবিও নেই আমাদের কাছে। পুলিশের দেওয়া এই বিপিএম সনদই এখন বাবার স্মৃতি। কিছু চাওয়ার নেই আমাদের, তবে একবার হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনিও সব হারিয়েছেন। আমরাও শিশু বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। আমাদের কষ্টের জীবনের কথা তাঁকে একটু জানাতে চাই। ‘
মাহফুজ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে তাদের কষ্টের জীবনের কথা শেয়ার করতে পারবেন কি না জানি না, তবে পঁচাত্তরের বীর এএসআই সিদ্দিকুরকে যথাযথ সম্মান আর মর্যাদা দেওয়া জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। সিদ্দিকুরের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে টিপু সুলতানের কথা। শ্রীরঙ্গপত্তমে ইংরেজরা যখন টিপু সুলতানের মৃতদেহ খুঁজে পায়, তাঁর হাতে তখনো তলোয়ার ধরা ছিল। চারণকবি লিখেছেন-
রূহ তো হো গ্যয়ি তন সে জুদা,
হাত তলওয়ার সে জুদা না হুয়া।
(দেহ ছেড়ে আত্মা চলে গিয়েছে, হাত তলোয়ার ছাড়েনি)
পনেরই আগস্ট এলেই আমি কল্পনায় এই লোকটাকে দেখি।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের নীচে পড়ে আছেন ছিন্নভিন্ন দেহে।
প্রাণ দেহ ত্যাগ করেছে বহু আগেই, কিন্তু হাত থেকে রিভলবারটি খসে পড়েনি।
মালিবাগে এসবি অফিসে কখনো যেতে হলে মূল ভবনের ডানপাশে একটু তাকান। এখানে তাঁর নামে একটা ব্যারাক আছে। দুটাকা দামের চাটার দল যখন জাতির পিতার নাম ভাঙিয়ে নিজের আখের গোছাতে চায়, তখন এই সিদ্দিকুর রহমানেরা যুগে যুগে বিলিয়ে যান স্বীয় প্রাণ।
তবুও কি তাকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না?
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
1. http://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2015/08/15/256569
2. http://archive.thedailystar.net/newDesign/cache/cached-news-details-216883.html
3. Mashroof Hossain, Additional Superintendent of Police, Bnagladesh Police

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top