নাটোরের ব্র্যান্ড কাঁচাগোল্লা
রেজাউল করিম রেজা, নাটোর। ।
কাঁচাগোল্লা নাটোরের একটি বিশেষ মিষ্টান্ন। ঐতিহ্যবাহী তো বটেই। এই ঐতিহ্যের ব্যাপ্তি শুধু বাংলাদেশে নয়, আছে দেশের বাইরেও। এর জনপ্রিয়তা শুরু হয় রানি ভবানীর সময় থেকে, যা আজও এতটুকু কমেনি।
কাঁচাগোল্লা নিয়ে অনেক গল্পই মানুষের মুখে শোনা যায়। সবচেয়ে বেশি শোনা যায় যে গল্পটি, তা অনেকটা এ রকম—রানি ভবানী মিষ্টি অনেক পছন্দ করতেন। তাঁর রাজপ্রাসাদে নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন লালবাজারের মিষ্টি বিক্রেতা মধুসূদন পাল। একদিন মধুসূদন পালের ২০ কর্মচারীর সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। দোকানে দুই মণ ছানা রাখা ছিল। ছানাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে মধুসূদন ছানার ওপর চিনির সিরা দিয়ে ভিজিয়ে দেন। এরপর এগুলো চেখে দেখেন স্বাদ হয়েছে অপূর্ব। এদিকে রানী ভবানীর লোকেরা মিষ্টি নিতে এলে তিনি সিরা দেওয়া ছানাগুলো পাঠিয়ে দেন রাজদরবারে। রানি ভবানী তা খেয়ে অনেক প্রশংসা করেন এবং মিষ্টির নাম জানতে চান। মধুসূদন পাল তখন কাঁচা ছানা থেকে তৈরি বলে এর নাম দেন কাঁচাগোল্লা।
দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লা : ১৭৬০ সালে রানি ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে কাঁচাগোল্লা ছাড়াও ‘অবাক’ সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে শীর্ষে ছিল কাঁচাগোল্লা। সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করানো হতো এই মিষ্টান্ন দিয়ে। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারেও এই কাঁচাগোল্লা যেত। রাজশাহী গেজেট পত্রিকায়ও কাঁচাগোল্লার খ্যাতির কথা বলা হয়েছে। সেই সময় লেখালেখি হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও।
জানা যায়, রাজা দ্বিজেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর এই কাঁচাগোল্লার ভক্ত ছিলেন। দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ন নাথ রায় শ্রীকৃষ্ণের উৎসবে সাধারণ মানুষকে এই মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। তখন কাঁচাগোল্লার কেজি ছিল তিন আনা।
প্রস্তুতপ্রণালী : উপকরণের মধ্যে আছে ছানা, মাওয়া, এলাচ গুঁড়া ও চিনি। মাওয়ার জন্য দরকার দুধ, ঘি ও পানি। কাঁচাগোল্লা মূলত দুই ধাপে তৈরি হয়। প্রথম ধাপে দুধ ও পানি মিশিয়ে একটি কড়াইয়ে জ্বাল দিতে হয়। মিশ্রণ ফুটতে থাকলে নাড়তে হয়। পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পর অল্প অল্প করে সিরকা মেশাতে হবে এবং নাড়তে হবে। দুধ জমাট বাঁধতে শুরু করলে এবং হালকা নরম হয়ে এলে সবুজ রঙের পানি যখন আলাদা হবে, তখন পাত্রটি নামাতে হবে। ছানার পানি ঝরাতে তা একটি ঝাঁঝরিতে রাখতে হবে। পরে ছানা একটি সিল্কের কাপড়ে বেঁধে সারা রাত ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ সময় কাপড় পেঁচিয়ে চাপ প্রয়োগ করেও পানি বের করা হয়। পানি বের করে ছানা একটি কাঠের পাটাতনে রেখে হাতের চাপ প্রয়োগ করে মিহি ছানা তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে ছানা তিন ভাগ করতে হয়। প্রথমে দুই ভাগ একটি পাত্রে মাঝারি আঁচে জ্বাল দিতে হয়। ছানার পানি বেরিয়ে গেলে হালকা নরম হলে মৃদু আঁচে অল্প চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে হয়। কিছুক্ষণ পর চিনি মেশানো ছানা আঠালো ভাব নেয়। তখন বাকি এক ভাগ ছানা মিশিয়ে নাড়তে হয়। এ সময় ক্রিম ও এলাচ গুঁড়া মিশিয়ে জ্বাল দিতে হয়। কিছু পরে হালকা গরম থাকতেই মসৃণ করে ছেঁকে ঠাণ্ডা করতে হয়। এরপর ওই মিষ্টান্নকে গুঁড়া গুঁড়া অবস্থায় কাঁচাগোল্লা হিসেবে বিক্রি করা হয়।
সাম্প্রতিক মন্তব্য