logo
news image

ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনার ট্রেনবহরে গুলিবর্ষণের মামলার রায় ৯ জনের মৃত্যুদন্ড

 ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ
 ঘটনার ২৫ বছর পর ঈশ্বরদীর বহুল আলোচিত শেখ হাসিনার ট্রেনবহরে গুলিবর্ষণের মামলার রায় আজ বুধবার সকালে জনাকীর্ণ আদালতে ঘোষণা করা হয়েছে। পাবনার স্পেশাল ট্রাইবুনালের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-১ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক রুস্তম আলী ২১ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ৫২ জন আসামীর মধ্যে  ৯ জনের মৃত্যুদন্ড, ২৫ জনের যাবজ্জিবন এবং ১৩ জনকে ১০ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।  এর মধ্যে ৫ জন ইতোমধ্যেই মৃত্যু বরণ করেছেন।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৯ জন হলো ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক মেয়র মকলেছুর রহমান বাবলু , পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, পাবনা জেলা বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক কে.এম.আক্তারুজ্জামান আক্তার, মাহবুবুর রহমান পলাশ, সাবেক কামিশনার শামসুল আলম, আজিজুর রহমান শাহীন, রেজাউল করিম শাহীন, মোস্তফা নূরে আলম শ্যামল ও অটল।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ২৫ জনের মধ্যে রয়েছে, আমিনুল ইসলাম আমিন, আজাদ হোসেন ওরফে খোকন, ইসলাম হোসেন জুয়েল, আলাউদ্দিন বিশ্বাস, শামসুর রহমান শিমু ওরফে শিমুয়া, আনিসুর রহমান সেকম, আক্কেল আলী, রবিউল ইসলাম রবি, এনাম, আবুল কাশেম ওরফে হালট কাশেম, কালা বাবু, মামুন-পিতা-আব্দুল এইচ মোঃ জলিল, মামুন পিতা জলিল গার্ড, সেলিম আহমেদ, কল্লোল, তুহিন-পিতা মীর কাইয়ুম, শাহ আলম লিটন, আবদুল্লা আল মামুন রিপন, লাইজু, আব্দুল জব্বার, পলাশ, আব্দুল হাকিম টেনু, আলমগীর , আবুল কালাম, এ কে এম ফিরোজুল ইসলাম পায়েল।
১০ বছরের কারাদন্ড প্রাপ্ত ১৩ জনের মধ্যে রযেছে, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নেফাউর রহমান রাজু, আজমল হোসেন ডাবলু, আনোয়ার হোসেন জনি, রনো, বরকত, চাঁদ আলী, এনামুল কবীর, মুক্তার, হাফিজুর রহমান মুকুল, হুমায়ন কবীর দুলাল, জামরুল, তুহিন বিন সিদ্দিক ও ফজলুর রহমান।
মোট ৫২ জন আসামীর মধ্যে বিগত ২৫ বছরে ৫ জন যথাক্রমে এহেতেশাম ওরফে ন্যাটা, আলমগীর হোসেন, ওসিয়া, খোকন ও আলমগীর হোসেন তুহিন মৃত্যুবরণ করেছেন।
রায় ঘোষণার খবর দ্রæত ঈশ্বরদীতে ছড়িয়ে পড়ে। ঈশ্বরদী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসাহাক আলী মালিথার নেতৃত্বে এবং যুবলীগ সভাপতি শিরহান শরীফ তমাল ও ছাত্রলীগ সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রনির নেতৃত্বে পৃথক দুটি আনন্দ মিছিল শহরে বের হয়।  
মামলার পিপি আক্তারুজ্জামান মুক্তা বলেন, এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ঠ। রায় সঠিক হওয়ায় মানুষ বিচার বিভাগের উপর আস্থাশীল হবে। উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে বলে তিনি আমা পোষণ করেন।
রায় প্রসংগে আসামী পক্ষের আইনজীবি এ্যাড. মাসুদ খোন্দকার বলেন, শুণানী গ্রহনের এক দিন পর ঘোষিত এই রায় আমরা মানিনা। আগেই রায় নির্ধারিত ছিল। রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার অন্যতম সাক্ষি সাবেক ভুমিমন্ত্রী, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান শরীফ এমপি রায় প্রসংগে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও এই রায় প্রমাণ করে যে, দেশে এখন যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নায়েব আলী বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক মোকলেছুর রহমান মিন্টু বলেন, এই রায়ে ঈশ্বরদী উপজেলা আওযামী লীগ খুশী। বিচারের রায় সঠিক হয়েছে, তাই এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ঠ। বিচার বিভাগের উপর মানুষের পূর্ণ আস্থা এই রায়ে আবারও প্রমানিত হলো।
ঈশ্বরদী পৌর আওযামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সেদিন বিএনপি নেত্রীর গাড়িতে গুলি বর্ষন ও বোমা হামলা চালিয়ে যে তান্ডব চালিয়েছিল, তাতে বিজ্ঞ আদালতের এই রায় যথার্থ। এই রায়ে সাধারণ মানুষের বিচার বিভাগের উপর আস্থা ফিরে আসবে।
রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব এবং সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মরদারের সাথে বারংবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা ফোন রিসিভ করেননি।
ঘটনা প্রবাহঃ
 ১৯৯৪ সালে বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দলীয় কর্মসূচিতে ট্রেনবহর নিয়ে রেলপথে খুলনা হতে ঈশ্বরদী হয়ে সৈয়দপুর যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশনে ট্রেনটি প্রবেশের পূর্ব মূহুর্তে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অতর্কিতে ওই ট্রেন ও শেখ হাসিনার কামরা ল্য করে উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে। ঈশ্বরদী ষ্টেশনে ট্রেনবহর যাত্রাবিরতি করলে পেছনের দিক হতে আবারো হামলা হয়। এ ঘটনায় দলীয় কর্মসূচি সংপ্তি করে শেখ হাসিনা দ্রæত ঈশ্বরদী ত্যাগ করেন।
পরে রেলওয়ে থানার (জিআরপি) ওসি নজরুল ইসলাম বাদি হয়ে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা ও বর্তমানে ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টুসহ ৭ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। কোন সাক্ষি না পাওয়ার কথা জানিয়ে একই বছর চুড়ান্ত প্রতিবেদনও পুলিশ দাখিল করে। কিন্তু আদালত এই প্রতিবেদন গ্রহন না করে পুনরায় তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সিআইডি তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ৩রা এপ্রিল আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। সিআইডির তদন্তে নতুন ভাবে ঈশ্বরদীর শীর্ষস্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীসহ ৫২ জনকে এই মামলার আসামি করা হয়। মামলা নম্বর এসটি ৪২/৯৭।
প্রথম চার্জশিটের ৭ আসামির বাইরেও এই মামলায় যাদের নতুনভাবে ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি মকলেছুর রহমান বাবলু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র শামসুল ইসলাম, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন বিশ্বাস, পাবনা জেলা বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক কে.এম.আক্তারুজ্জামান আক্তার, পাকশীর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, সাহাপুরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নেফাউর রহমান রাজু, সাবেক ছাত্রনেতা মাহবুবুর রহমান পলাশ, রেজাউল করিম শাহীন, আজিজুর রহমান শাহীন, সেলিম আহমেদ, পৌরসভার কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন জনি, বিএনপি নেতা ইসলাম হোসেন জুয়েল, শহীদুল ইসলাম অটল, আব্দুল জব্বার। আসামিদের মধ্যে গত ২৫ বছরে ওসিয়া, আলী আজগর, খোকন, তুহিন ও আলমগীর ইতোমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাবেক ভূমিমন্ত্রী, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান শরীফ এমপি, ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান বিশ্বাস, পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোকলেছুর রহমান মিন্টু, ম্যাজিষ্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনসহ ৩৮ জনের সাধারণ সাক্ষি এবং আসামী পক্ষে ৫৬ জনের সাফাই সাক্ষি গ্রহন করা হয়।  
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৩০ জুন মামলার আরো সাফাই সাক্ষির দিন ছিল। আসামীপক্ষ  সাফাই সাক্ষি না দিয়ে আবারো সময়ের প্রার্থনা করলে আদালত নামঞ্জুর করে উপস্থিত ৩০ আসামীর জামিন বাতিল করে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। সেইসাথে ১লা জুলাই সোমবার  যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য্য করা হয়।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার প্রধান আসামি ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, সাবেক সভাপতি ও ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক মেয়র মকলেছুর রহমান বাবলু  এবং অন্যতম আসামি পৌর এবং বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবীর দুলালসহ আরো ১৭জন আদালতে হাজির না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আদালত জারি করেন।
 গত ১ জুলাই যথারীতি আদালত উভয় পক্ষের শুণাণী গ্রহন শেষে আজ বুধবার রায় ঘোষণার দিন ধার্য্য করেন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন, পাবনার জজকোর্টের পিপি এ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান মুক্তা ও এ্যাডভোকেট গোলাম হাসনাইন। অপরদিকে আসামী পক্ষে ছিলেন, এ্যাড. মাসুদ খোন্দকার, এ্যাড. নূরুল ইসলাম গেদা ও এ্যাড. সনত কুমার সরকার। পলাতক আসামীদের পক্ষে শুণানী করেন, এ্যাড. এ কে এম শামসুল হুদা।
২ জুলাই ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক মেয়র মকলেছুর রহমান বাবলু  ও আবুল হাকিম টেনু আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানালে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। আজ ৩ জুলাই এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে ২৫ বছর আগের চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটলো।   

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top