১৯ বছরে লালপুরে দেড় শতাধিক খুন
ইমাম হাসান মুক্তি।।
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লালপুরে দেড় শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪টি রাজনৈতিক খুন সংঘটিত হয় উপজেলার গোপালপুর পৌরসভা এলাকায়। লালপুরে যত খুন, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও আধিপত্যের ঘটনার পেছনে রয়েছে আর্থিক বিষয়। অর্থনৈতিক স্বার্থের উৎসের মূল ক্ষেত্র সুগার মিল। যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরাজমান কোটি টাকার বৈধ ও অবৈধ বাণিজ্য আর লুটপাট। আর এই অর্থের উৎস ও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব আর খুনের মিছিল আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে পৌর এলাকায় চরম খুন আতংক বিরাজ করছে জনমনে। এই খুনের মিছিল বন্ধ হওয়া সময়ের দাবি।
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা। দেশের সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতম স্থান। প্রধান অর্থকরী ফসল আখ।
লালপুর থানার নথি ও বিভিন্ন ইতিহাস পর্যালোচনা জানা যায়, পদ্মা নদী ও চলনবিল অঞ্চলে ঠগী বা গামছা মোড়া জলদস্যুদের অত্যাচারের ফলে ১৮২৭ সালে লালপুর (বিলমাড়িয়া) একটি পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়। বৃটিশ শাসক স্যার লর্ড লরেন্সের শাসনামলে ভারত সরকারের পক্ষে পুলিশ ১২/০৩/১৮৬৯ তারিখের ১৬৯৫ নং স্মারকে ২.১৩ একর জমি লালপুর থানা নির্মানের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। শেরশাহের আমলে নির্মিত গ্র্যান্ডটাঙ্ক রোডের পাশে অধিগ্রহনকৃত বালিতিতা মৌজার জমির খতিয়ান নং ১৬৭ ও জেএল নং- ১৯৮। ১৮৯৯ সালের ৩১ মার্চ লালপুর থানা ভবনের উদ্বোধন করা হয়। মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬ কক্ষের ছাদের ঘরে থানার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯১৫ সালের ১৯ এপ্রিল একটি চারচালা টিনের ঘর ব্যরাক হিসাবে নির্মান হয় দুই হাজার টাকা ব্যয়ে। ১৯৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর থানা ভবন একহাজার ৫৯৮ টাকায় সংস্কার করা হয়। ১৯৩৩ সালের ১৫ মার্চ মাত্র ৩৯৪ টাকায় একটি রান্না ঘর নির্মান করা হয়। সর্বশেষ নতুন দ্বিতল ভবন (সম্প্রসারণ চারতলা) ও সীমানা প্রাচীর নির্মান করা হয়।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড উত্তরাঞ্চলের ভারি শিল্পের মধ্যে অন্যতম। ১৯৩০ সালে সুরুজমাল ও নাগরমল নামে দুই মাড়োয়ারি পাট ব্যবসায়ী সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানায় লালপুরের গোপালপুর চিনিকল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৩ সালে মিলটি পরীক্ষা মূলক উৎপাদন শুরু করে। ১৯৩৩-৩৪ আখ মাড়াই মৌসুমে এই চিনিকল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিনি উৎপাদন আরম্ভ করে। ১৯৬৫ সালে ব্যক্তি মালিকানাধীন (মেসার্স সুরুজমাল ও নাগরমাল) অবস্থায় জাভা হতে ক্রয়কৃত সেকেন্ডহ্যান্ড চিনিকলটি সরকারি মালিকানায় নেওয়া হয়। ওই সময় থেকে মিলের ৪ হাজার ৯৫৯.৬২৭৫ একর জমি নিয়ে চিনিকলের কার্যক্রম শুরু হয়। মাড়াই মৌসুমে আখ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সাধারণ চাষীদের আখ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ৮ টি বাণিজ্যিক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা করা হয়। মিলটির অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল শিল্প পার্ক প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে ৩২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকার নাটোরের লালপুর নর্থ বেঙ্গল চিনিকল উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর লালপুর উপজেলার গোপালপুর ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই পৌরসভার আয়তন ১৬.১৬ বর্গ কিলো মিটার।
লালপুর থানা, সংবাদপত্র ও স্থানীয় সূত্রমতে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৯ বছরে লালপুরে দেড় শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪টি রাজনৈতিক খুন সংঘটিত হয় উপজেলার গোপালপুর পৌরসভা এলাকায়। ১৯৯১,০১৯৯২, ১৯৯৮ সালে বিশেষ খুনের ঘটনাসহ নাটোরের লালপুর উপজেলায় ২০০০ সালে ১০টি, ২০০১ সালে ৯টি, ২০০২ সালে ৮টি, ২০০৩ সালে ৮টি, ২০০৪ সালে ৬টি, ২০০৫ সালে ১৪টি, ২০০৬ সালে ১৬টি, ২০০৭ সালে ২টি, ২০০৮ সালে ১০, ২০০৯ সালে ৯টি, ২০১০ সালে ৪টি, ২০১১ সালে ৭টি, ২০১২ সালে ৯টি, ২০১৩ সালে ১২টি, ২০১৪ সালে ৯টি, ২০১৫ সালে ২টি, ২০১৬ সালে ১টি, ২০১৭ সালে ২টি, ২০১৮ সালে ২টি, ২০১৯ সালে ২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। চরাঞ্চলে লালচাঁদ ও পান্নাবাহিনীর তান্ডবে পাঁচ (২০০২-২০০৬) বছরে লালপুরের রমজান হাফেজ, মুকুল, ভাসান, শাহজাহান, বকুল আলী, আমির, কুদ্দুস ও হাতু খুন হন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অনেক খুনের ঘটনা থানায় রেকর্ড হয়নি বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। যার তথ্য এখানে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।
এসব খুনের মধ্যে শুধুমাত্র মমতাজ উদ্দিন ও খান্নাস হত্যার বিচার হলেও বাঁকি খুনের মামলা অন্ধকারে রয়েছে। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়নি। আবার অনেক খুনের মামলার আসামী জামিনে, কেউ পলাতক, কেউ ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৯১ সালের ২২ জুন ঈদের আগের রাতে গোপালপুর পৌরসভার মধুবাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তোফা। খুনের স্থান তোফা কাটা মোড় হিসেবে পরিচিত। পরের বছর ১৯৯২ সালের ২২ জুন উত্তরবঙ্গেন আখচাষী নেতা আব্দুস সালাম খুনের মাধ্যমে শুরু হয় দিবালোকে খুনের ইতিহাস। সকাল ১০টায় নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ২ নং গেটের সামনে ওয়ার্কাস পার্টির নেতা কমরেড আব্দুস সালামকে প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীরা গুলি হত্যা করে।
১৯৯৮ সালের ২৪ মে উপজেলা যুবলীগের সদস্য মুনছুর আলীকে (২৮) কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলার হাবিবপুর গ্রামে ছাত্রলীগ কর্মী মোয়াজ্জেম হোসেন খান্নাসকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০০৩ সালের ২৫ মে সুগারসেসের টেন্ডার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, আহত ১০, গুলি, ককটেল, ভাংচুর করা হয়।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মমতাজ উদ্দিন দলীয় কাজ শেষে ২০০৩ সালের ৬ জুন রাত ১০টার দিকে গোপালপুর থেকে আব্দুলপুরের মিল্কিপাড়ার নিজ বাড়ি ফেরার পথে দাইরপাড়া রাস্তায় তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়।
২০০৫ সালের ১৪ জানুয়ারি গোপালপুর পৌর স্মশানের নিকট যুবদল নেতা রজব আলী পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। ২০০৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রশিদ (৩৭) দলীয় কোন্দলের জের ধরে আড়বাব গ্রামে যাওয়ার পথে বাউড়া বটতলার আদূরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত মিন্টু ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা যায়।
চরাঞ্চলে লালচাঁদ ও পান্নাবাহিনীর তান্ডবে পাঁচ (২০০২-২০০৬) বছরে লালপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পাবনায় ৩০ খুন, ৪০০ পরিবার গৃহহারা হয়। এর মধ্যে লালপুরের রমজান হাফেজ, মুকুল, ভাসান, শাহজাহান, বকুল আলী, আমির, কুদ্দুস ও হাতু খুন হন। ২০০৬ সালের ৫ জুন র্যাবের ক্রসফায়ারে রাজশাহীর বাঘার জোতরাঘোব এলাকায় পান্না বাহিনীর প্রধান কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের মাঝদিয়ার গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মান্নান ওরফে রানা আহমেদ ওরফে পান্না নিহত হয়।
২০০৮ সালের ২৩ জুন নাটোরের লালপুর উপজেলার ভূইয়াপাড়া ব্রিজের নিকট বর্ণার বিলের আখক্ষেত থেকে রফিকুল ইসলাম (৩৫) নামের এক ব্যক্তির গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে বিজয়পুর নামক স্থানে দুস্কৃতিকারীরা সাখাওয়াত হোসেন (৪০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে।
২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে উপজেলার নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের গ্যারেজের পেছনে মিলের আখ ক্ষেতে মীর হাসান মাহমুদ সৈকত (১৯) খুন হয়।
নাটোরের লালপুর পদ্মারচর থেকে জালাল উদ্দিন (২৫) নামের এক কলেজছাত্রর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে বন্ধুদের হাতেই হত্যার শিকার হন জালাল উদ্দীন।
২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি দুপুর ১টার দিকে লালপুর-বাঘা সড়কের বাদলিবাড়ি (তিনখুঁটি) এলাকায় মোশাররফ হোসেন (৩৮) নামের এক কলেজশিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে তার মোটরসাইকেল নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল এলাকায় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের বিরোধের জেরে জাহারুল ইসলাম (৩৮) নামে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
গোপালপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পৌর আওয়ামী লীগের সদস্য জামিরুল ইসলাম (৪৩) দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন। ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি বেলা ১টার দিকে পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের বিরোপাড়া মহল্লায় এ ঘটনা ঘটে।
২০১৯ সালের ১২ জুন উপজেলার গোপালপুর পৌর এলাকার মনির উদ্দিন আকন্দ রোডে বেলা আড়াইটার দিকে আলোক বাগচি (৫০) নামের একজনের বুকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ০৪/০৮/২০০০, ২৬/০৫/২০০১, ১৭/০৩/২০০২, ০৪/০২/২০০৯ তারিখে গোপালপুর পৌরসভায় খুনের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সময়ে খুন, সংঘর্ষ, লুটপাটের ঘটনা লালপুরের মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে।
লালপুরে অপ্রত্যাশিত হত্যাকান্ডের ঘটনার কারণ, হত্যাকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত বা দোষী এবং হত্যাকান্ড-সন্ত্রাসী ঘটনা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নাগরিক জীবন নিশ্চিত করতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের মতামত নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে গোপালপুর ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আকরাম হোসেন বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। এর জন্য রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী মহল অনেকাংশে দায়ি। রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সুশীল সমাজের সঠিক ভূমিকার মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা রোধ করা সম্ভব।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণ। মূলত পুলিশি তৎপরতা, পর্যবেক্ষণ ও গোয়েন্দা নজরদারির অভাব খুনের ঘটনার জন্য দায়ী। পুলিশ, রাজনৈতিক, সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের নিয়ে মতবিনিময়, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তৎপরতা, জিজ্ঞাসাবাদ, সন্ত্রাসীদের জামিন আদেশ বাতিলের পদক্ষেপ নিলে মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে।
গোপালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র মুঞ্জুরুল ইসলাম বিমল বলেন, লালপুরে খুনের ঘটনাগুলো প্রধানত রাজনৈতিক রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিহিংসা না থাকলে কোন হত্যাকান্ড হবে না। সকল রাজনৈতিক দলের এক্যমত্য ও প্রশাসনিক তৎপরতার মাধ্যমে সহিংস হত্যাকান্ড রোধ করা সম্ভব।
গোপালপুর পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম মোলাম বলেন, পৌরসভায় অধিকাংশ খুনের ঘটনা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ঘটেছে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। খুনের ঘটনা এড়াতে জনসচেতনতা ও অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, লালপুরে বিশেষ করে গোপালপুর পৌরসভা এলাকায় খুনের সবগুলোই রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। হত্যাকান্ডের দায়ভার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বসত: প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির ওপর চাপানোর কারণে প্রকৃত খুনীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বার বার খুনের ঘটনা ঘটিয়ে সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কৌশল খাটিয়ে উৎসুক নেতৃত্ব আইনের ওপর প্রভাব বিস্তার করায় প্রকৃত খুনীদের উৎসাহিত করা হয়েছে। খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে জনশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয় না। তাই সকল খুনের ঘটনার জন্য কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা আছে। সকলকে সহনশীল মানসিকতার পরিচয়, উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিহিংসা মূলক কর্মকান্ড পরিহার, সর্বপরি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর অপকর্মের দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে নিজেদের সংশোধনের মাধ্যমে সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিহত করা সম্ভব।
এ ব্যাপারে লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নজরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, লালপুর উপজেলা নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা। পদ্মা নদীর বিশাল চর ও সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সন্ত্রাসীরা যে কোন অপরাধ করে সহজেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে পৌরসভা এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাভূক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনসচেনতা বাড়াতে সমাবেশ করা হয়েছে। সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেলে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব হবে।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মুল বানীন দ্যুতি বলেন, ব্যক্তিগত শত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে লালপুরে খুনের ঘটনা ঘটছে। মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসাও সন্ত্রাসের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। স্বাক্ষী-প্রমানের অভাবে বিচার কার্য ব্যহত হওয়ায় সন্ত্রাসীরা ছাড়া পাওয়ায় অঘটন ঘটছে। মাদক নির্মূল, চলাফেরায় নিজেদের সতর্কতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সাধারণ মানুষের সহযোগিতা, প্রশাসনিক তৎপরতা খুন-সন্ত্রাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
লালপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশিদ পাপ্পু বলেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল কেন্দ্রিক আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ইন্ধন এসব অপরাধের জন্য মূলত দায়ী। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত হলে এ ধরণের হত্যাকান্ড ও সন্ত্রাস অনেকাংশে কমে আসবে।
লালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসাহাক আলী বলেন, গোপালপুর পৌরসভাসহ লালপুরে আগে থেকেই কিছু সন্ত্রাসী, খুনী ও ছিনতাইকারী ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অপরাধ ঘটিয়ে আসছে। এই সব অপরাধীদের দীর্ঘ দিনের অপতৎপরতার ফল বিভিন্ন সময়ের হত্যাকান্ড। মূলত: রাজনৈতিক নেতৃত্বে পৃষ্ঠপোষকতা, আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণকারী (পুলিশ প্রশাসন) সংস্থার ব্যর্থতা, বিশেষ করে পৌরসভা এলাকায় সকল দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘাটতি এবং খুনের ঘটনা সমুহের বিচারহীনতা অপরাধের ঘটনার জন্য দায়ী। সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের আন্তরিক তৎপরতার মাধ্যমে সকল অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌরসভা ও সুগার মিল আর্থিক সংস্থানের ক্ষেত্র। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য বিস্তারে হত্যাকান্ড লাগাম ছাড়া বেড়ে চলেছে। সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবাধ বিচরনের সুযোগে অপরাধ করছে। প্রশাসনের নজরে অবাধে চলাচল করেও পলাতক দেখানোতে সন্ত্রাসের অভয়রণ্যে বসবাস করছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে পদক্ষেপ নিলে লালপুরের অপরাধ প্রবণতা প্রতিহত করা সম্ভব। তিনি বলেন, তাঁর পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) কোন সন্ত্রাসী রাজনৈতি প্রশ্রয় পায়নি জন্য কোন খুন-রাহাজানি হয়নি। এ সময় সন্ত্রাসীরা হয়তো পলাতক, নয়তো জেলে থেকেছে। সব ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে ছিল।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, লালপুরে খুনের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এসব খুনের অন্যতম কারণ যারা রাজনীতি করা মানে বুঝে তারা মনের এখন আমি নেতা, এই জনপদ আমার, এটা আমার লিখিত সম্পত্তি অতএব এখন আমি যা করবো তাই হবে। গোপালপুরে খুনের অন্যতম কারণ গোপালপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, আয়-উপার্জনের ক্ষেত্র। এখানে রেজিস্ট্রি অফিস, গোডাউন ব্যবসা, সুগার মিল, পৌরসভা বিধায় এখানে যারা বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বে রয়েছে তারা মনে করে যে এই জায়গা আমাদের নিয়ন্ত্রনে থাকলে আমাদের জন্য লাভজনক। সব সময় এখানে গ্রুপিং সৃস্টি করে খুন-খারাপি করা, মামলা-মোকাদ্দমায় ঝুলিয়ে দেওয়া রেওয়াজ হয়ে গেছে। বিপদ গ্রস্থ মানুষদের তখন নেতাদের কাছে যেতেই হয়। সে কারণেই এই রকম একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে রাখে। আর সেই ধারাবাহিকতায় খুন-খারাপিগুলো হয়। তিনি বলেন, আমি এমপি হওয়ার পর মনেকরি যেখানে অবৈধ অস্ত্রের উৎস আছে সেখানেই সন্ত্রাস, বন্দুকবাজি, সেখানেই পেশী শক্তির ব্যবহার, সেখানেই ক্ষমতার দাপট এগুলো হয়। এজন্য আমি শপথ গ্রহণ করার পর প্রথম চাঁদাবাজি বন্ধ করেছি। রেজিস্ট্রি অফিসে সরকারি ফির অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধ করেছি। টেন্ডারবাজি যাতে কেউ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছি। আমি কোন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদক কারবারিকে প্রশ্রয় দেয় না। এমনকি যারা আমার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তাদেরকেউ কোন অবৈধ সুবিধা দিচ্ছি না। ক্ষমতার অপব্যবহার করার কোন সুযোগ এখন পর্যন্ত আমি দিই নি। সবাই সেটা জানে। আমি আমার জনপদটাকে শান্তির জনপদ গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। সকল মানুষের কাজ বুঝে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। লালপুরের পদ্মার চরে প্রস্তাবিত নাটোর অর্থনৈতিক জেলা সদরে চলে যাচ্ছে। এটাকে উজ্জীবিত করে লালপুরেই রাখার চেষ্টা করিছি। যাতে আমার এলাকার জনগণের অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি আসে। সুগার মিলে শিল্প পার্ক বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে সংসদে কথা বলেছি। এলাকার রাস্তাঘাটগুলো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাকা করা হবে। কোন রাস্তা কাঁচা থাকবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে ছয়টি ভবন দেওয়া হয়েছে। যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো একাডেমিক ভবন পায়নি সেগুলোর জন্য জোর তদবির চালাচ্ছি। এলাকাটা আমাদের সকলের। সকলকেই এলাকাকে ভালবাসতে হবে।
রাজনীতি মানে আমি মনেকরি জনগণের কল্যানে কাজ করা, আর এলাকার উন্নয়ন করা। আমি সেটা করেই জনগণের ভালবাসা অর্জন করতে চাই। বিভিন্ন অপরাধের ক্লু খুঁজে যেকোন মূল্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য আমি প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। খুন বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনগনের শক্তি বড় শক্তি। গুটি কয়েকজন সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি করে। অধিকাংশই সাধারণ নিরিহ মানুষ। জনগণ এক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে রুখে দাঁড়াতে হবে। এখনই সেই সময়। এজন্য জনগণের ওপর যদি কোন আঘাত আসে আমি প্রতিহত করবো। বিভিন্ন সময় আইন-শৃংখলা সভায় এ কথা বলেছি। আমি সকল দলের, সকল মানুষের এমপি। সকলের এক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনেকরি।
* ইমাম হাসান মুক্তি: সম্পাদক, দৈনিক প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ও অধ্যক্ষ, মাজার শরীফ টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট উইমেন্স কলেজ, লালপুর, নাটোর।
সাম্প্রতিক মন্তব্য