logo
news image

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামচা

জুলফিকার আলি মাণিক।  ।  
শহর জুড়ে অগণিত স্থির নামফলক এবং সড়কে অস্থির চলমান মটর সাইকেলের নম্বর প্লেটগুলো একটি আজন্মের বিতর্ক ও বিভাজনের গল্প বলছে। পঁয়ত্রিশ বছর হলো চাঁপাই নবাবগঞ্জ নামে জন্মেছে জেলাটি। শহরের সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তিগত নামফলক গুলোতে জেলার নাম তা-ই লেখা আছে। দেশের সব জেলায় দেশের সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ যানবাহনগুলো নিবন্ধন করে সেই জেলার নামে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ব্যতিক্রম। এই জেলায় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যানবাহনের নিবন্ধন দেয় ‘নবাবগঞ্জ’ নামে। ১৯৮৪ সালে যখন জেলা হয় তখন থেকেই এর নাম নিয়ে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দেয়। নবাবগঞ্জ জেলা চায় অনেকে আবার কোন অংশের ইচ্ছায় তার আগে ‘চাঁপাই’ শব্দ জুড়ে দিয়ে জেলার নাম রেখে দেয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কিন্তু আজও যে তা সার্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি, হয়নি গ্রহণযোগ্য সে কথা দৃশ্যমান জেলা সদরেই।
দেশের পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ভারতের সীমান্ত ঘেষা জেলা। ভারত ভাগের আগে ছিল সে দেশের মালদহের ভেতরে। বৃটিশরা ভারতবাসীকে সফলভাবে বিভক্ত করতে পারলে আজকের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৯৮৪ সালে চলে আসে রাজনৈতিক পাকিস্তান সীমারেখার রাজশাহী জেলায়। একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশে পয়ত্রিশ বছর আগে আদালত ঘোষিত এক অবৈধ সামরিক শাসকের সিদ্ধান্তে নিজেই একটি জেলা হয়ে ওঠে।
দেড় দশকেরও বেশি সময় পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে প্রায় তিন দশকের পুরোনো বন্ধুর দেখা মিললো। সংক্ষেপে ডলার নামে পরিচিত, পুরো নাম রবিউল হাসান ডলার। পেশায় সাংবাদিক। ইংরেজি ভাষার দৈনিক পত্রিকা ডেইলি স্টারের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি; আমি এখন না থাকলেও বছর দশেক আগেও সেই পত্রিকায় আমরা সহকর্মী ছিলাম। আমি ছিলাম ঢাকায় তিনি চাপাইনবাগঞ্জে। পুরোনো বন্ধুত্বের বিষয়টি তখনও আবিস্কার হয়নি। এই মার্চে চাপাইনবাগঞ্জের এক সন্ধ্যা রাতের আধো আলোয় প্রথম দেখায় চেহারাটা পরিচিত ঠেকে। কিন্তু স্থির করতে পারছিলাম না কেন এতো পরিচিত ঠেকছে। ডলারই মনে করিয়ে দিলেন, ১৯৯০-৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মধুর ক্যান্টিনে তুমুল আড্ডার দিনগুলোর কথা। ডলার পড়তেন সাংবাদিকতায় আমি ব্যবস্থাপনায়। আমাদের পড়ালেখার বিভাগ ছিল ভিন্ন, কিন্তু দীর্ঘ সময় আড্ডার জায়গা ছিল এক। ভীষণ সংগ্রামী জীবন এই বন্ধুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও ফিরে আসতে হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সাংবাদিকতা করলেও প্রকৃতির জন্য তাঁর বেজায় টান, ভালবাসা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ‘সেভ দ্য নেচার’ নামে এক সংগঠন গড়ে তুলেছেন ২০১৫ সাল থেকে। নিজেদের পকেটের অর্থ দিয়ে তারা কাজ করছেন। আমার কাজের পর অবসরে নিয়ে গেছেন জেলা সদর থেকে ১৫/২০ কিলোমিটার দূরে এক বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে। এলাকাটির নাম বাবুডাইন। এ ধরণের বন এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিরল। জেলাজুড়ে সমতল এলাকার মাঝে সামান্য উঁচু নিচু টিলা এলাকা। পাহাড়ী এলাকার স্বাদ দেয় খানিকটা। শুকনো মৌসুম বলে মার্চে এখানে প্রকৃতির রং ধূসর, বাদামী। ঝরা পাতার গাছগুলোকে বড্ড বিবর্ণ, উলঙ্গ লাগে। তবে বর্ষায় নাকি বেশ ঘন জঙ্গল হয়ে ওঠে চারদিক। বিচিত্র গাছ আর পাখির দেখার নেশা আছে যাদের তাদের জন্য এটা মোহণীয় জায়গা। আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী ডলার ও তাঁর বন্ধুরা বললেন, এই বন এলাকা নাকি একময় সাগরের তলদেশ ছিল। তাই এখানের ভূমির গঠন আর রুপে ভিন্নতা আছে। আছে প্রাকৃতিক খারি বা খাল। দারুণ শান্ত সুন্দর এই প্রাকৃতিক এলাকাটি সংরক্ষণে কাজ করছে ডলারদের সংগঠন সেভ দ্য নেচার। প্রকৃতি সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টি করতে তারা নিজ খরচে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। কারও সাহায্য নেয়নি, নিজেরাই মাটি খুড়ে স্থাপন করেছে। নিজেদের প্রকৃতি রক্ষার কাজটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই করতে চায় তারা। দারুণ সব স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে সাহিত্যে স্থান পাওয়া নানা জঙলি গাছ, ফুল আর সুন্দর কিছু পাখিরও দেখা মিললো সেখানে। অনেক গাছ, ফুল, পাখির নাম জানিনা। একটা ফুল দেখিয়ে ডলার বললো জীবনান্দ দাশের ‍‍"ঘেটু ফুল। " ফুলের মত দেখতে একটা কাঁচা ফলের নাম 'ঝাপা।' যৌবন হরানো শুকনো ঝাপা ফুলও বেশ সুন্দর দেখায়। একটা ঈগলের পিছে ছুঁটে তার ভাল ছবি মিললো না। ঝুঁটি ওয়ালা একটা অপরুপ পাখি জীবনের প্রথম দেখলাম। তারও মনমতো ছবি তোলা যায়নি। পাখিটার নাম ডলার বলে দিল। ইংরেজিতে ‘কমন হুপি’ আর বাংলায় ‘হুদ হুদ। ’ (লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া)।  
* জুলফিকার আলি মাণিক, সাংবাদিক, ১৪ই মার্চ, ২০১৯, ঢাকা। 

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top