logo
news image

কুষ্টিয়া হাসপাতাল ভবন ছাদ ঢালাইয়ে দুর্বল নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ও গাফিলতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়া।  ।  
ঢালাই কাজে দুর্বল নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নিয়ম না মানাসহ নানা অনিয়মের কারনেই কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাদে ধসের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার (১৯ জানুয়ারি) একাধিক তদন্ত দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এমন সব তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। এদিকে ছাদ ধসের ঘটনার পর পুরো ভবনের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আজাদ জাহানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অন্য দুই সদস্য হলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এবং এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এএসএম শাহেদুর রহিম।
এদিকে ছাদ ধসের ঘটনার পর বাস্তবায়ন পরীবিক্ষন ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি’র) (স্বাস্থ্য ও গৃহায়ন) পরিচালক সাইফুল ইসলাম ও উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সরেজমিন ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছেন। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ধসে পড়া অংশে যান। যেখান থেকে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন।  তার আগে সেখানে মেডিকেল কলেজের পিডি ডা. আশরাফুল হক দারা, গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে মিটিং করেন। এর আগে সকালে ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আজাদ জাহানসহ তার দলের অন্য দুই সদস্য। তারা দীর্ঘ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। এ সময় এ টিমের সদস্যরা বেশ কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পান। তারা বিষয়টি উর্দ্ধতনদের জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিমের একজন সদস্য বলেন, প্রাথমিকভাবে কাজ দেখে মনে হয়েছে যে ঠিকাদার এ কাজ করছে তার এমন কাজ করার কোন অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নেই। এটা ঠিকাদারের অদূরদর্শিতা।  যে ধরনের ভারি ঢালাই হচ্ছিল সেটা এ বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ঠেকানোর মত সহ্য ক্ষমতা ছিল না। তিনি বলেন, সামনের যে দুটি পিলার আগে করা ছিল, তার সাথে দুই পাশে দুটি বিম আগেই করার দরকার ছিল। মূল ভবনের দিকে বিম থাকলেও দুই পিলারের পাশে কোন বিম ছিল না। এ কারনে ৩০ফিট বাই ৫০ ফিটের যে বড় ঢালাই কাজ চলছিল সেটা ধসে পড়ে। আর ঠিকাদারের কোন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নেই। তারা অনেকটা ইচ্ছামত কাজ করার কারনেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এর দায়ও স্থানীয় গণপূর্ত অফিস কোনভাবেই এড়াতে পারে না। ওই সদস্য আরো বলেন, বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করা ছিল বোকামি। এমন যে উচ্চতায় ঢালাই দেয়া হচ্ছিল লোহার পাইপ ব্যবহার করলেও তা ঝুঁকি থাকতো। অসাবধানতা ও না জানার কারনেই ছাদটি ধসে পড়ে।
সিডিউলে যেভাবে কাজ করার কথা সেই ভাবে ছাদ ঢালাই কাজটি হয়নি। অনেকটা তড়িঘড়ি করে ঢালাই কাজ করা হয়। যার কারনে অনেক বিষয় এড়িয়ে যায় ঠিকাদারের লোকজন। এছাড়া গণপূর্তের লোকজনেরও গাফিলতি ছিল বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অনেক বেশি প্রাণহানি ঘটতে পারত। এসব বিষয় তারা প্রতিবেদনে তুলে ধরবেন।
মোবাইলে কথা হলে টিমের প্রধান আজাদ জাহান বলেন, আমরা ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। কিছু অনিয়ম সামনে এসেছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে আমরা প্রতিবেদন দাখিল করব। তখনই অনিয়মের বিষয়টি সবাই জানতে পারবে। এখনই এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। এদিকে আইএমইডির দুই কর্মকর্তাও খতিয়ে দেখছেন নানা বিষয়। ঢালাই কাজে সিডিউলে লোহার পাইপ ব্যবহারের কথা থাকলেও তা করা হয়নি বলে মনে করছেন তদন্ত টিমের সদস্যরা। এছাড়া বাঁশ ব্যবহার করা হলেও তা ছিল পুরাতন। বিভিন্ন সময় এসব বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। বেশির ভাগ বাঁশ ফাটা ছিল। এছাড়া কাঠও ব্যবহার করা হয়েছে পুরাতন ও নিন্মমানের। এসব কারনে ঢালাই শেষ হওয়ার আগে পুরো ছাদটি ধসে পড়ে। এতে চাপা পড়ে এক শ্রমিক মারা যায়। আহত হয় ৬জন।
আইএমইডির পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি। সেগুলো কাগজপত্রের সাথে মিলিয়ে দেখব। তারপরই বলতে পারব আসলে কি কি অনিয়ম হয়েছে এখানে।’
এদিকে এ ঘটনার পর অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে স্থাণীয় প্রশাসন ও গণপূর্তের কর্মকর্তারা। এখন ছাদ ঢালাই ধসের পর ভবনের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এসব বিষয় নিয়ে গণপূর্তের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রশ্নের সম্মুখীন। তারা বিষয়টির কোন জবাব দিতে পারছে না। এদিকে ঠিকাদারের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হলেও ছাদ ঢালাইয়ের সময় গণপূর্তের কোন প্রকৌশলী সেখানে উপস্থিত ছিল না বলে জানা গেছে। এসব বিষয় নিয়েও তারা বিচলিত।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের প্রজেক্ট ডাইরেক্টটর (পিডি) ডা. আশরাফুল হক দারা বলেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের যে কাজ চলছে তার সবটাই দেখভাল করছে গণপূর্ত। তারায় বিষয়টি ভাল বোঝে। কি কারনে এমন ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তের পরই বের হয়ে আসবে। তখন বোঝা যাবে আসলে গাফিলতি কার ছিল। তাই তদন্ত রিপোর্ট না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি বলা যাচ্ছে না কি ধরনের অনিয়ম হয়েছে এবং তা কারা করেছে।’
কুষ্টিয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল হান্নান খান বলেন,‘ ঢাকা থেকে একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। গণপূর্তের একটি টিম আসার কথা রয়েছে। সব বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল ভবনের গাড়ী বারান্দার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছিল বৃহস্পতিবার । সেখানে কাজ করছিলেন শতাধিক নির্মাণ শ্রমিক। কাজ চলাকালে বিকেল সাড়ে৪টার দিকে হঠাৎ করে বিকট শব্দে ওই ছাদ ধসে পড়ে। এ ঘটনায় এক শ্রমিক ছাদের নিচে চাপা পড়েন। আহত হন আরও ৬ শ্রমিক। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। প্রায় ২ ঘন্টার উদ্ধার কাজ শেষে ছাদের নিচে চাপাপড়া শ্রমিক বজলুর রহমানের মৃতদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। সংশ্লিষ্টদের ধারণা নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সাধারণত নির্মাণাধীন ছাদের সাটারিংয়ে স্টীলের পাইপ ব্যবহার করা হলেও এখানে বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ছাদে যে পরিমান রড দেওয়ার কথা তার থেকে কম রড ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ। এই দুই কারণে ছাদের ঢালাই কাজ চলাকালে এভাবে ছাদ ধসে পড়ে। এদিকে, দুর্ঘটনার পর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহুরুল হকের প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। অন্যদিকে উদ্ধারকাজ চলাকালে নির্মাণ কাজের তত্বাবধানে থাকা কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের কোন কর্মকর্তাকেও সেখানে দেখা যায়নি।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top