logo
news image

আবাদি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে মাঠে নেমেছেন ডিসি

মাহবুব হোসেন।  ।  
অবৈধভাবে তিন ফসলি আবাদি জমি নষ্ট করে পুকুর খননের বিরুদ্ধে এবার মাঠে নেমেছেন নাটোরের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মাদ শাহরিয়াজ। মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) সকালে তার নেতৃত্বে বড়াইগ্রামের জোয়াড়ী ও গুরুদাসপুরের চাপিলা ইউনিয়নে ভ্রাম্যমান আদালতের পৃথক দু’টি অভিযান চালানো হয়। এ সময় জোয়াড়ী থেকে কৃষি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খননের অভিযোগে খোরশেদ মন্ডল নামে এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানে গুরুদাসপুরের চাপিলা ইউনিয়নে একই ভাবে কৃষি জমিতে পুকুর খননের দায়ে আব্দুস সামাদ নামে এক ব্যক্তির ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও দু’টি মাটি কাটা মেশিন জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে নিয়ম মাফিক মামলাও দায়ের করা হয়েছে। ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদনান চৌধুরি।
অপরদিকে, অভিযানের সময় আবাদি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন না করার জন্য মানুষের মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে মতবিনিময় সভা করেছেন জেলা প্রশাসক। স্থানীয় চাপিলা ইউনিয়ন পরিষদে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনির হোসেনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন, জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ শাহরিয়াজ। এছাড়া অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ড. রাজ্জাকুল ইসলাম, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা নাসিম হোসেন, মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর কবিরসহ বিএডিসি এবং পানাসি প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, ধানের চেয়ে মাছে লাভ বেশি হওয়ায় গত চার বছর ধরে তিন ফসলি জমি খুঁড়ে পুকুর তৈরী করছে এক শ্রেণীর লোভি কৃষকরা। অপরিকল্পিত ভাবে যেখানে, সেখানে পুকুর খননের কারনে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। এতে করে বাড়ি-ঘর এবং রাস্তা-ঘাটে ক্ষতির মুখে পড়ছে সাধারণ মানুষরা। স্থানীয় কৃষি বিভাগের হিসাব বলছে, নাটোরে গত সাত বছরে অন্তত চার হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে গেছে। এর দুই-তৃতীয়াংশই এখন পুকুর। বাকিটা বসতবাড়ি, ইটভাটা আর রাস্তা ঘাট। এ নিয়ে বেশ চিন্তিত কৃষি বিভাগ। নাটোর কৃষি বিভাগের হিসাবে, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের আগে পর্যন্ত আবাদি জমিতে পুকুর খনন সহনীয় মাত্রায় ছিল। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে এ প্রবণতা স্থানীয় কৃষকদেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নতুন পুকুর খনন করা হয়েছে নয় হাজারের বেশি।
সূত্র আরো জানায়, ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০-১১ অর্থবছর পর্যন্ত নাটোর জেলায় আবাদি জমি খুব একটা কমেনি। কিন্তু এরপর থেকেই আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে জেলায় আবাদি জমি ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৩৮ হেক্টর, তা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৮ হেক্টরে। অর্থাৎ এই সাত বছরে কমেছে ৪ হাজার ১৭০ হেক্টর। ফলে আবাদি জমি পুকুরে গিলে খাওয়ার কারনে মাথা ব্যাথার কারনে হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন সকল শ্রেণী পেশার মানুষের।
মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের অভিযানে গিয়ে দেখা যায়, নাটোরের বড়াইগ্রামের মৌখাড়া থেকে গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা অর্থাৎ ১০কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত চার শতাধিক পুকুর চোখে পড়ে। পুকুর হওয়া এসব জমিতে এক সময় ব্যাপক পরিমানে রসুনের আবাদ করতেন কৃষকরা। কিন্তু রসুন সহ অন্যান্য আবাদ বাদ দিয়ে পুকুর খনন করেছে তারা। তাদের এই পুকুর খনন করার কারনে জলাবদ্ধ মারাত্বক রুপ নিয়েছে। অনেকে বসতবাড়ি মাটি দিয়ে উঁচু করতে হচ্ছে। বর্ষাকাল এলেই জলাবদ্ধতার শিকার হতে হয় তাদের। মৌখড়া এলাকার সবেজান বেগম বলেন, ঘরের সাথে জমির মালিক পুকুর খনন করেছে। বারবার বাধা দেওয়ার পরও সে কথা শুনেনি। বরং উল্টো হুমকি দিয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে তার কাছ থেকে মাটি কিনে বাড়ি-ঘর উঁচু করছি। কারন বর্ষাকাল এলেই ব্যাপক পরিমানে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়।
বড়াইগ্রামের জোয়াড়ী এলাকার অবৈধ পুকুর খননকারী খোরশেদ মন্ডল বলেন, ধান, রসুন সহ অন্যান্য ফসল করে তেমন লাভ হয়না। যার কারনে পুকুর খনন করে মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছি। পুকুর খনন করতে কোন টাকাও লাগেনা। ইটভাটার মালিকরা পুকুর খনন করে মাটি নিয়ে তারা ভাটায় চলে যায়। যার কারনে সহজেই পুকুর খনন করা যাচ্ছে।
গুরুদাসপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, চাপিলা ইউনিয়নে প্রায় চার হাজার পুকুর থাকার পরেও সেখানে আবাদী জমি নষ্ট করে নতুনভাবে পুকুর খননের মাধ্যমে কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই চাপিলা ইউনিয়নে প্রায় ছয়শ’ কৃষি জমি মাটি কাটা মেশিন দিয়ে খনন করে পুকুর করা হয়েছে। এলাকায় প্রভাবশালীদের কারণে অতিরিক্ত পুকুর খনন করায় দরিদ্র কৃষক পরিবার তাদের জমিতে ফসল চাষাবাদ করতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এছাড়াও বর্ষার সময়ে বৃষ্টির পানি বের হতে না পেরে এলাকার নীচু জমি ও রাস্তায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। এতে করে গুরুদাসপুর এলাকার সাধারণ মানুষের চলাচল ব্যহত হচ্ছে।
অভিযানে অংশ নেওয়া অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক ড. রাজ্জাকুল ইসলাম পুকুর খননকারীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারন করে বলেন, আগামী দিনে নাটোর জেলায় আর একটি পুকুরও খনন হবেনা। তিন ফসলি জমিতে যাতে আর একটি পুকুরও না হয় সেজন্য সাতটি উপজেলায় কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হবে। পুকুর খননকারীদের কোন ছাড় হবেনা বলে হুশিয়ারী দেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ শাহরিয়াজ বলেন, চাপিলা ইউনিয়নে অভিযানের মধ্যে দিয়ে অবৈধ পুকুর খননের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হল। নাটোরের আবাদি জমির প্রতিটি মাটি যাতে আর পুকুরে ব্যবহার না হয় সেজন্য আমি নিজেই সকল স্থানে অভিযান পরিচালনা করবো। পুকুর খনন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top