logo
news image

ওবামার কোলের সেই বাংলাদেশি শিশুটি এখন দেশে

নাজনীন আখতার।  ।  
একজন দীর্ঘদেহী কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির কোলে এক শিশু। চোখে-মুখে শিশুসুলভ দুষ্টু–মিষ্টি কৌতূহল খেলা করছে। বয়স মাত্র ১৫ মাস। তাই কার কোলে চড়েছে, সেই ব্যক্তি কত ক্ষমতাবান, বিশ্ব শাসনে সেই ব্যক্তি কতটা পরাক্রমশালী, সেসব জটিল হিসাব–নিকাশের কোনো বালাই নেই তার। বরং তাকে কোলে নিতে পেরে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষকেই বেশি আনন্দিত মনে হচ্ছে।
ছবির ক্ষমতাবান সেই পুরুষ আর কেউ নন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে চমক রয়েছে শিশুটির ক্ষেত্রে। কারণ, শিশুটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইয়ান জুয়েল। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশি শিশু আইয়ান জুয়েল। তার বাবা জুয়েল সামাদ ওই সময় বার্তা সংস্থা এএফপির হোয়াইট হাউসবিষয়ক ফটোসাংবাদিক ছিলেন। এ বছরের মার্চ মাস থেকে তিনি এএফপির দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার প্রধান ফটোসাংবাদিক হিসেবে ব্যাংকক কার্যালয়ে নিযুক্ত হয়েছেন।
আইয়ান জুয়েলের বয়স এখন আট বছর। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য মা-বাবা দেশে এসেছেন। মা-বাবা আর ছোট বোন চার বছরের অ্যালিনের সঙ্গে সেও এসেছে। রাজধানী ঢাকার কাঁঠালবাগানে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট রোডে খালার বাসায় উঠেছে। সেখানে বসেই গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথা হলো আইয়ান ও তার বাবা–মায়ের সঙ্গে। স্বভাবে শান্ত ছোট্ট মেয়েটির কথায় কথায় একান-ওকান বিস্তৃত হাসি বলে দিচ্ছিল এ দেশের সবকিছু তার বেশ পছন্দ। তাই তো ছুটিছাটায় যেকোনো অজুহাতে দেশে আসতে তার আগ্রহের কমতি নেই।
এ দেশের সবচেয়ে বেশি কী ভালো লাগে—জিজ্ঞেস করতেই দুই হাত ওপরের দিকে তুলে তুমুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল, ‘কাজিন’। এরপর কী ভালো লাগে? একই ভঙ্গিতে জবাব, ‘রিকশা’। এরপর? জবাব, ‘শাক আলু’। হয়তো শাক আলুর প্লেট সামনে রাখা ছিল বলে এত চটজলদি জবাব!
গল্পে গল্পে আইয়ানের সঙ্গে ফিরে আসা হলো ছবির প্রসঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই ছবি তোলার সময়ের কোনো কিছু তার স্মৃতিতে নেই। সেই সময়ের কথাটা শুনতে হলো তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তবে ছবিটি নিয়ে এখন তার বেশ উচ্ছ্বাস রয়েছে। বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো ছবিটি দেখে বন্ধুদের ‘চিৎকার’ তাকে বেশ আনন্দ দেয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় স্কুলের বন্ধুরা তার বাড়িতে এসে ছবিটি দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেত।
বন্ধুরা কী বলত—জানতে চাইলে তা অভিনয় করে দেখাল আইয়ান। দুই হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে বলল, ‘ওএমজি’। বন্ধুরা বলত, তুমি এত ‘পাওয়ারফুল’, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছবি! তবে সেই তুলনায় ব্যাংককের বন্ধুদের তেমন উচ্ছ্বাস নেই। তারা ওবামাকে ‘চেনে’ না।
বাবা জুয়েল সামাদ বললেন, হোয়াইট হাউসে বড়দিনের অনুষ্ঠানে তিনি মেয়েকে নিয়ে আগেভাগে চলে গিয়েছিলেন। স্ত্রী গোধূলি খান—এএফপির সাবেক ফটোসাংবাদিক—অনুষ্ঠানের শেষ দিকে তাঁদের সঙ্গে এসে যোগ দেন। হোয়াইট হাউস থেকে তাঁর বাসার দূরত্ব ছিল গাড়িপথে ২৫ মিনিটের, মেরিল্যান্ডের সিলভার স্প্রিংয়ে। অনুষ্ঠানে কারও ব্যক্তিগত ক্যামেরা বা ফোন বহনের অনুমতি ছিল না। ছবিটি তুলে দিয়েছিলেন হোয়াইট হাউসের নিজস্ব আলোকচিত্রী। পরে ছবিটি হাতে পাওয়ার পর স্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট করলে দেশে তা নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়।
জুয়েল সামাদ জানান, ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ঢাকায় এএফপির ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর নিযুক্ত হন পাকিস্তানে। ২০০৫ সালে পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া ও পরে ২০০৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস, ২০০৮ সালে ওয়াশিংটন এবং ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে নিযুক্ত হন। এ বছরের মার্চে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার প্রধান ফটোসাংবাদিক হিসেবে ব্যাংকক কার্যালয়ে নিযুক্ত হয়েছেন। এসবের আগে তিনি ঢাকায় মর্নিং সান ও জনকণ্ঠে ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন।
আইয়ানের মা গোধূলি খান জানান, দেশে আসার ব্যাপারে আইয়ানের খুবই আগ্রহ রয়েছে। দেশে আসার কথা শুনলেই সে আনন্দে লাফঝাঁপ শুরু করে। তিনি বলেন, ‘ওকে (আইয়ান) যখন গল্প বলা শুরু করি, তখন থেকেই কল্পকাহিনির পাশাপাশি দেশের গল্পই বেশি বলেছি। সে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানে, ভাষা আন্দোলনের কথা জানে। কোনো কিছু নিয়ে তার মনে দ্বিধা হলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেয়। দেশকে স্বাধীন করতে এ দেশের অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, এটা তাকে খুব ব্যথিত করে।’
মা কথা বলার সময় মাথা নেড়ে তাতে সায় দিয়ে আইয়ান বলে, এটা তাকে কষ্ট দেয়।
সাভারে স্মৃতিসৌধে মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে আইয়ান। ছবি: জুয়েল সামাদের সৌজন্যেসাভারে স্মৃতিসৌধে মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে আইয়ান। ছবি: জুয়েল সামাদের সৌজন্যেএবার দেশে এসে স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনার ঘুরে এসেছে সে। স্মৃতিসৌধ কেন স্থাপন করা হয়েছে জানো? জিজ্ঞেস করতে ইংরেজিতে বলল, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বাংলাদেশের অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল, তাদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। আর শহীদ মিনার? ‘পাকিস্তানিরা তাদের ভাষায় আমাদের কথা বলতে হবে বলেছিল।’
গোধূলি খান বলেন, ‘শহীদ মিনারে বেদিতে ওঠার সময় তাদের দুই বোনের জুতা খুলে দিলে তারা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। তাদের বললাম, শহীদ মিনারে আমরা খালি পায়ে শ্রদ্ধা জানাই।’
গোধূলি খান ২০০৩ থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ঢাকায় এএফপিতে ফটোসাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি জনকণ্ঠে ফটো সাংবাদিক ও দৈনিক সংবাদে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন।
আইয়ানের চার বছর বয়সের এক কথা তুলে ধরতে গিয়ে গোধূলি খান বলেন, ‘ওই সময় দেশে এসে গ্রিন রোডের ভাঙা রাস্তা আর যেখানে–সেখানে ময়লা দেখে বলেছিল, “হু টেক কেয়ার অব বাংলাদেশ, আই নিড টু নো।” কেন লোকজন রাস্তাগুলোকে ভালোবাসছে না, সে নিয়েও তার দুঃখ বোধ ছিল। রাস্তার “দেখভালের” দায়িত্ব যাঁর, তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে চেয়েছিল সে।’সূত্র: প্রথম আলো

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top