logo
news image

মুক্তিযুদ্ধ ও একটি ত্যাগের গল্প

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।  ।  
ঈদের দিনেও আনন্দ নেই আনোয়ারা বেগমের মনে। একমাত্র ছেলে ও স্বামী বন্দি জেলে। আগামীকাল ছেলে মুক্তি পাবে বলে কথা দিয়েছে। আগামীকাল সন্তান ফিরে আসবে সেই চিন্তায় পাগলপ্রায় আনোয়ারা। কতোদিন দেখে না সন্তানের মুখ! অপেক্ষার প্রহর যেনো কাটতেই চায় না। পথের দিকে চেয়ে আছে সেই সময়ের অপেক্ষায় কখন ফিরে আসবে আদরের সন্তান। মা বলে জড়িয়ে ধরবে বাহুডোরে। ঈদের দিনেও কোন রান্না হয় না তার চুলায়। সন্তান ফিরে এলেই রান্না হবে, তারপর একসাথে খাবে। রাত নামে, তবু ঘুম নেই আনোয়ারা বেগমের চোখে। চোখের সামনে ভাসছে সন্তান ফিরে আসার দৃশ্য। ফজরের নামাজ পড়েই ভাই ফজলুকে ডেকে তুললেন। তারপর স্বামী সন্তানের জন্য নাস্তা তৈরি করে গামছায় বেঁধে দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা। ফিরে না আনোয়ারা ঘরে। ফিরে আসে ভাই ফজলু, ফিরে না সন্তান। তবে স্বামী সন্তানের পরিহিত কাপড় ফেরত নিয়ে এসেছেন ভাই ফজলু। আর এমনই নির্দেশ ছিলো গোলাম আযমের চিঠিতে।
১৯৭১ সাল, ২৫ মার্চ কালো রাতে ছিলেন ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাক বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের তান্ডব দেখে মুক্তির শপথ নেন এসআই শিরু মিয়া। তারপর ২৭ মার্চ কুমিল্লা জেলার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে বাড়িতে ফিরে যান স্ত্রী আনোয়ারা বেগমসহ সপরিবারে। মাধবদী সীমান্ত পার হয়ে মুজিব নগরে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানান। এরপর ফিরে এসে নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন ট্রানজিট ক্যাম্প। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের পরিবারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সচিব ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বজনদেরকে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। একমাত্র সন্তান দশম শ্রেণির ছাত্র আনোয়ার কামাল ছিলো তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। নিরস্ত্র বাঙালিদের নিরাপদে সীমান্ত পার করা ছিলো তার প্রধান কাজ।
২৫ অক্টোবর নিজ বাসাতেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এক বৈঠকে বসেন শিরু মিয়া। হোমনা, দাউদকান্দি, নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন অস্ত্র ও গ্রেনেড। ২৬ অক্টোবর রাতে নতুন অস্ত্র, গুলি ও গ্রেনেডের চাহিদা নিয়ে নৌকায় রওনা হন মুজিব নগরের উদ্দেশ্যে। ছেলে কামালও আছে সাথে। ২৭ অক্টোবর দুপুরে রাজাকারদের তৎপরতায় তন্তর চেকপোস্টে ছেলে ও সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ছয়জন আটক হন। পাক বাহিনীর অফিসার ও সৈন্যরা এসে প্রচন্ড অত্যাচার ও পিটমোড়া করে বেঁধে নেয় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া কোর্ট বিল্ডিং-এর সামনে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় জনগণকে দেখানো হয় পাকিস্তানের আনুগত্য না মানার পরিণাম। অসহ্য যন্ত্রণা ও কষ্টের মাঝেও আটক মুক্তিযোদ্ধারা শিশু কামালের মুক্তির জন্য আকুতি জানায়। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি বন্দী এই মুক্তিযোদ্ধাদের। টানা আটদিন চাবুক মেরে, গরম লোহার ছ্যাকা দিয়ে ও বিভিন্ন কৌশলে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয় কুমিল্লা জেল খানায়।
২৯ অক্টোবর সাব-ইন্সপেক্টর শিরু মিয়ার স্ত্রী জানতে পারেন তার স্বামী সন্তানের আটকের খবর। এরপর অনেক জায়গায় চেষ্টা করেও কোন সুরাহা না করতে পেরে শেষে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় মহসীনের মাধ্যমে চলে যান জামায়াতে ইসলামীর প্রধান গোলাম আযমের নিকট। আনোয়ারা বেগমের সকল আর্তনাদ শুনে গোলাম আযম মুখ বন্ধ খামে এক চিঠি লিখে হাতে দেন তার। বললেন এই চিঠি কুমিল্লা জেলা রাজাকার কমান্ডারের হাতে দিলে তার সন্তান ও স্বামীকে মুক্তি দেয়া হবে। সেই চিঠি নিয়ে ১ নভেম্বর আনোয়ারা বেগম ও তার ভাই ফজলু মিয়া গেলেন কুমিল্লা রাজাকার কমান্ডারের নিকট। মুখ বন্ধ চিঠি খুলে পড়ে কিছুটা হেসে বললেন ২০ নভেম্বর ঈদের পরদিন ছেলে কামালকে মুক্তি দেয়া হবে। এসআই শিরু মিয়াকে পাঠানো হবে পুলিশের চাকুরীতে। এরপর জেলখানায় মামা ফজলুর সাথে দেখা হয় কামালের। সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে কামাল লিখে “আম্মা সালাম নিবেন। আমরা জেলে আছি। জানি না কবে ছুটব। ভয় করবেন না। আমাদের উপর তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে। দোয়া করবেন। আমাদের অনেকদিন জেলে থাকতে হবে। ঈদ মোবারক। কামাল।” কামাল আরেকটি চিঠি লেখে তার নানাকে।
২১ নভেম্বর ঈদের পরদিন মামা ফজলু জেলখানায় গেলে শিরু মিয়া ও কামালের পরিহিত কাপড় ফেরত দেয়া হয়। ফজলুর হাতে বোন জামাই ও ভাগনের পরিহিত কাপড়ের ওজন এক পাহাড় সমান। কারণ ঈদের আগে ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় তিতাস নদীর পাড়ে শিরু মিয়া ও কামালসহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। শুধুমাত্র গোলাম আযমের নির্দেশের প্রতি সম্মান জানাতে তার চিঠির বক্তব্য “মহিলাকে তার স্বামী ও পুত্রের কাপড় ফেরত দেয়া হোক” অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে রাজাকার কমান্ডারের লোক।
মুক্তিযুদ্ধে হাজারো পুলিশ শহীদ হয়েছেন দেশের জন্য। জীবন বাজি রেখে হাজারো পুলিশ যুদ্ধ করেছেন দেশ মাতৃকার টানে। এসআই শিরু মিয়ার এমন করুণ পরিণতির কথা প্রথম বহুল প্রকাশ পায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদের বক্তব্যে। তিনি এই হত্যাকান্ডে গোলাম আযমকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী যে ৬২টি অভিযোগ আনা হয় তার মধ্যে অন্যতম এই হত্যাকান্ড। স্বামী সন্তান হারিয়ে আনোয়ারা বেগম এখন অনেকটাই বাকরুদ্ধ। দেশের জন্য এ সকল পুলিশ সদস্যের মহান আত্মত্যাগ আজও আমাদের উজ্জীবিত করে।
লেখক- হাফিজুর রহমান

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top