logo
news image

গাজীপুরের এসপি শামসুন্নাহারের ছুটে চলা

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।  ।  
জীবনে কত কিছুই তো ভালো লাগে। কখনো কখনো সেই ভালো লাগা স্বপ্নের বীজ বুনে দেয়। তবে সেই বীজ চারা বা মহিরুহ হবে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন কয়জন! কত স্বপ্ন অঙ্কুরেই শেষ হয়, সেই জায়গা পূরণ করে নতুন নতুন ভালো লাগা ও স্বপ্ন। তবে যাঁরা স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন এবং সেই স্বপ্নকে ঘিরেই অধ্যবসায়ী হন, তাঁরা নিশ্চয় ওই দলভুক্ত হবেন না। শামসুন্নাহার তেমনই একজন ব্যক্তি।
শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সত্যি, একটি ইউনিফর্মের প্রতি ভালো লাগা থেকে হৃদয়কোণে স্বপ্ন বুনেছিলেন তিনি। আজ তাঁর গায়ে সেই ইউনিফর্ম। বলা যায়, সেই ইউনিফর্ম বেশ আগেই তাঁর গায়ে উঠেছে। তবে ইউনিফর্মের কোনায় যুক্ত হওয়া নতুন নতুন ব্যাজ জানান দিচ্ছে, তিনি সাধারণ উর্দিধারী নন। তাঁর হেঁটে চলা পথে ঘুরে বেড়ায় চারপাশের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি। শ্রম আর মেধায় নিজেকে সেই অবস্থানে নিয়ে গেছেন তিনি।
শামসুন্নাহারের ভাষায়, ‘ইউনিফর্মের নেশা’ তাঁর এখনো কাটেনি। তাঁকে দেখে কোনো না কোনো মেয়ের মনে যেন এই ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, সূক্ষ্মভাবে সেই চেষ্টা থাকে তাঁর।
২৫ অক্টোবর শুরুতে সকাল সোয়া ১০টায় গাজীপুরের শ্রীপুর সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের গেট দিয়ে ঢুকলেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার। তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের হুইসিল, উপস্থিত জনতার ভিড় সব দেখে মাঠে লাইন করে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের চোখে অপার বিস্ময়। এসপি শিক্ষার্থীদের মাদক, জঙ্গি ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে করণীয় সম্পর্কে বললেন। শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পাঠ করালেন। এর মধ্যেই খবর এল শ্রীপুরে এক যুবকের দুই হাত শরীর থেকে কেটে ফেলে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নির্ধারিত কর্মসূচি ফেলে এসপি ছুটলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। স্বজনদের মাথায় হাত বুলিয়ে ও দিকনির্দেশনা দিয়ে শামসুন্নাহার ছুটলেন নিহত যুবকের বাড়ি এবং ঘটনাস্থলে।
একজন নারী এসপির এই ছুটে চলা দেখতে মানুষ খুব একটা অভ্যস্ত নন। তাই যেখানেই যাচ্ছেন, তাঁকে দেখতে এগিয়ে আসা মানুষের জটলা সামলানো নিরাপত্তারক্ষীদের বাড়তি দায়িত্বে পরিণত হচ্ছিল। এসপি শামসুন্নাহার যেখানেই যাচ্ছিলেন, নিজের মুঠোফোনের নম্বরটি লোকজনকে দিয়ে বলছিলেন প্রয়োজনে তাঁকে ফোন দেওয়ার জন্য। উপস্থিত লোকজনের চোখে–মুখে একধরনের স্বস্তি দেখা গেল, যেন বিপদে আস্থা রাখার মতো কোনো অভিভাবক পেলেন তাঁরা।
যুবকটি যেখানে খুন হয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে এসপি শামসুন্নাহার কাজের ফাঁকে একবার আক্ষেপ করে বলেন, ‘জনগণ সম্পৃক্ত না হলে অপরাধ দমন করা কঠিন। অপরাধী জানে, খুন করলেও ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছাতে কম করে হলেও ঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগবে। এই যুবককে সবার চোখের সামনে দিনের আলোয় গাড়িতে তোলা, কোপানো, হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা, তারপর ফেলে রেখে চলে যাওয়া—অপরাধীদের অনেক সময় লেগেছে, অথচ এই যুবকটিকে কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি, সব জায়গায় এই একই অবস্থা হয়।’
গাজীপুরের এসপি শামসুন্নাহার এর আগে চাঁদপুরে এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত হন। গাজীপুরে দায়িত্ব পালন করছেন দুই মাসের বেশি সময় ধরে। দিনের কর্মসূচিতে স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলার পর স্কুল থেকে কাছেই শ্রীপুর থানা প্রাঙ্গণে ওপেন হাউস ডে তে শামসুন্নাহারের এলাকার জনগণের সঙ্গে বসার কথা ছিল। জনগণ দুপুর পর্যন্ত বসেই ছিলেন। শ্রীপুরের কড়ইতলায় খুন হওয়া যুবকের বাড়ি, সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তাঁর লাশ ফেলা হয়। এসব জায়গা ঘুরে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরত্বে আবার থানায় ফিরলেন শামসুন্নাহার। এলাকাবাসীর কাছ থেকে নানা সমস্যার কথা শুনে সে অনুযায়ী নির্দেশনা দিতে দিতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। থানায় দুপুরের খাবার খেলেন তিনি। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে এলাকার এক ব্যক্তি তাঁর মেয়েকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে এলেন। তাঁর সঙ্গে মেয়ে ও যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিও ছিলেন। দুই পক্ষের কথা শুনলেন শামসুন্নাহার।
খাওয়া শেষ হতেই শামসুন্নাহার ছুটলেন শ্রীপুর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরত্বে গাজীপুরের জয়দেবপুরে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। কার্যালয়ে ঢুকতে ঢুকতে বিকেল প্রায় চারটা। সেখানে এসপির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন বিভিন্ন বয়সী নারী, শিশু। কেউ কেউ আবার সবার সামনে সমস্যার কথা বলবেন না, তখন তাঁকে ভেতরের কক্ষে নিয়ে কথা বললেন তিনি।
শামসুন্নাহারের জন্ম ফরিদপুর। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গ্রামেই ছিলেন। তাঁরা দুই ভাই, দুই বোন। বাবা মো.শামসুল হক পেশায় আইনজীবী। মায়ের নাম আমিনা বেগম।
শামসুন্নাহার বলেন, ‘ছোটবেলায় হাট, ঘাট, বিল, ঝিল দাপিয়ে বড় হয়েছি। সাঁকো হেঁটে পার হওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। আর এই অভিজ্ঞতাগুলোই পুলিশ প্রশিক্ষণ এবং পরবর্তী দায়িত্ব পালনে কাজে লাগছে।’
কেন পুলিশ হতে চাইলেন?
এমন কথার জবাবেই উঠে এল পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা। শামনসুন্নার বলেন, ‘পরিবারের সবাই আমাকে ব্যারিস্টার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়ার সুযোগ পেলাম না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম।’
জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে চরম হতাশায় দিন কাটছিল। হলের পক্ষ থেকে বিএনসিসিতে যোগ দেওয়ার পর বিমান শাখায় তিনিসহ সেরা ১০ জনকে একটি কোর্সের জন্য নির্বাচিত করা হয়। কোর্সে গিয়ে ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয়। সিদ্ধান্ত নিলেন, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশে যোগ দেবেন।
হাসতে হাসতে শামসুন্নার বলেন, ‘ইউনিফর্মের নেশা এখনো কাটেনি আমার। কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে আমি যতক্ষণ পারি, ইউনিফর্ম পরে থাকি। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে। আমাকে দেখে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যেও যেন পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন জাগে, সেই চেষ্টা করি।’
পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্যারেডে প্রথম নারী অধিনায়ক হিসেবে পরপর দুবার নেতৃত্ব দেওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন শামসুন্নাহার।
এ পেশার চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গিয়ে জানান, চাঁদপুরের তুলনায় গাজীপুরে চ্যালেঞ্জের মাত্রা একটু বেশি। গাজীপুরে স্থায়ী মানুষের পাশাপাশি অস্থায়ীভাবে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এই অস্থায়ী মানুষের এলাকার উন্নয়নে বা স্থানীয়দের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। অপরাধ করে অন্য এলাকায় চলে যেতে পারেন। পোশাকশিল্প কারখানার শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা, জমি দখল, বন দখল, ব্যবসায়িক দলাদলি, ট্রাফিক জ্যামসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং জঙ্গিবাদের মতো সমস্যা তো আছেই।
ভারী কথার একপর্যায়ে উঠে এল সংসারের গল্পও। তাঁর মতে, সংসারকে প্রাধান্য দিতেই হবে। তাঁর দুই সন্তান। ১৭ বছর বয়সী ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করছে। দেশে তাঁর সঙ্গে রয়েছে সাড়ে ৬ বছর বয়সী মেয়ে। স্বামী হেলাল উদ্দিন ব্যবসায়ী। স্বামীসহ পরিবারের সবাই তাঁর চাকরির ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিচ্ছেন বলে জানান। তাঁর মতে, সংসারে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়।
বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড পাওয়া শামসুন্নাহার জানালেন, মেয়েকে প্রচণ্ড জ্বরে রেখে সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। এখন ঘরে ফিরে মেয়ের মুখোমুখি হওয়ার পালা। সূত্র: প্রথম আলো

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top