logo
news image

যত গাছ তত পাখি

মুক্তার হোসেন।  ।  
একটা সময় ছিল, যখন নাটোরের গ্রামগুলোতে লোকজন পাখি শিকার করত। বিশেষত চলনবিল ও হালতি বিলের পাড়ের মানুষ ফাঁদ পেতে পাখি ধরত, বন্দুক দিয়ে পাখি মারত। গাদা বন্দুকের গুলির শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে বক, শামুকখোল, ভাড়ই, বেলেহাঁস আরও কত নাম–না–জানা জলচর পাখি উড়ে চলে যেত।
এসব দৃশ্য দেখেছিল বিলপাড়ের কিশোর রাব্বি। তার খারাপ লাগত। রাব্বি হয়েছে ঠিক তার বাবার মতো, তার বাবাও পাখি শিকার করা সইতে পারতেন না। খাঁচায় বন্দী পাখি ছেড়ে দেওয়ার জন্য পাখির মালিককে অনুরোধ করতেন। বাবার আরও একটা ঝোঁক ছিল। গাছ লাগানোর। রাস্তার পাশে যেখানেই একটু ফাঁকা জায়গা দেখতেন, সেখানেই গাছ লাগাতেন। এ জন্য হাট থেকে ফেরার সময় গাছের চারা কিনে নিয়ে আসতেন।
বাবা আজ নেই। কিন্তু তাঁর লাগানো গাছগুলো আছে। কিশোর রাব্বি এখন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। নাটোরের নলডাঙ্গা উপজলার মাধনগর কলেজে স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র। কিন্তু এই পরিচয়ে তাঁর স্বরূপ প্রকাশিত হয় না। তাঁকে সবাই চেনে গাছ ও পাখির বন্ধু হিসেবে। ‘আমার যখন মন খারাপ হয়, তখন আমি বাবার লাগানো গাছগুলো জড়িয়ে ধরি। গাছের পাখিগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। মন ভালো হয়ে যায়।’ এ–ই হলো ফজলে রাব্বির প্রকৃত স্বরূপ।
কিন্তু শুধু বাবার লাগানো গাছগুলো আলিঙ্গন করা আর সেসব গাছের পাখিদের দিকে চেয়ে থাকাই রাব্বির কাজ নয়। তিনি আরও বড় কাজ করেন। বছর তিনেক আগে, ২০১৫ সালের মে মাসে নিজের গ্রাম মাধনগরে গড়ে তুলেছেন ‘সবুজ বাংলা’ নামের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রথমে এর সদস্য ছিল ২১ জন শিশু–কিশোর। পাখিশিকারের বিরুদ্ধে কথা বলা ছিল তাদের প্রথম কাজ। কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনত না, পাখিশিকারিরা ভ্রুক্ষেপই করত না। কলেজের ছাত্র ফজলে রাব্বি ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, দেশে বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তাবিষয়ক আইন হয়েছে। সেই আইনে পাখি শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাঁরা এটা প্রচার করে বলতে লাগলেন: পাখি মারবেন না, এটা অপরাধ।
সবুজ বাংলা
 স্লোগান: ‘যত গাছ তত পাখি’
 সদস্য: ১২০ জন
 শাখা: ৫টি গ্রামে
 মর্যাদা: বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশন (বিবিসিএফ) সাথি সংগঠন।
 স্বীকৃতি: বন বিভাগের (রাজশাহী) ক্রেস্ট ও সম্মাননা সনদ। সেভ দ্য নেচার, ঢাকা পুরস্কার।
এতেও যখন পাখিশিকারিদের বোধোদয় হলো না, তখন রাব্বি ও তাঁর সবুজ বাংলার কর্মীরা সরকারি প্রশাসনের কাছে পাখিশিকারের খবর দিতে শুরু করলেন। ফলে পাখিশিকারিরা সতর্ক হয়ে উঠল। কিন্তু তারা পাখি শিকার একেবারে ছেড়ে দিল না। রাব্বি উপলব্ধি করলেন, জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য আরও বড় আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সেই প্রয়োজনবোধ থেকে রাব্বি নাটোরের আরও পাঁচটি গ্রামে সবুজ বাংলার শাখা সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এখন সবুজ বাংলার মোট নিবন্ধিত সদস্য ১২০ জন। তা ছাড়া তাঁদের অনেক সমর্থক সৃষ্টি হয়েছে; তাঁরা সবুজ বাংলাকে নগদ অর্থ, পাখির খাবার, পাখির বাসা বানানোর উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করেন। সবুজ বাংলা এখন বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) সদস্যভুক্ত সংগঠন। এর সদস্যরা বিবিসিএফ ও বন বিভাগের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও অংশ নেন।
সবুজ বাংলার স্লোগান ‘যত গাছ তত পাখি’। তাই সংগঠনটি গাছ লাগানোর পাশাপাশি পাখিদের জন্য নিরাপদ বাসাও তৈরি করে দিচ্ছে। এর সদস্যরা নাটোরের উত্তরা গণভবনের গাছে গাছে পাখিদের নিরাপদে বসবাসের জন্য মাটির হাঁড়ি দিয়ে বাসা তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁরা এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক পাখির বাসা তৈরি করেছেন। তাঁরা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আলোচনা সভা ও লিফলেট বিতরণসহ নানা প্রচারণামূলক কাজ করছেন। তাঁরা আহত ও অসুস্থ পাখিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযান ও শিকারিদের সরঞ্জামাদি জব্দ করার কাজেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বন বিভাগকে সহযোগিতা করেন।
সবুজ বাংলা প্রশাসন, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় তিন বছরের মধ্যে নাটোরের মাধনগর, বাঁশভাগ, রামশার-কাজীপুর, ঠাকুর-লক্ষ্মীকুলসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে পাখিশিকার বন্ধ করতে পেরেছে। নাটোরের বিলপাড়ের গ্রামগুলো পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে।
ফজলে রাব্বি স্বপ্ন দেখেন, একদিন সারা বাংলাদেশই পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হবে। সূত্র: প্রথম আলো

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top