logo
news image

গ্রামীণ প্রেমের মুগ্ধতা

মোঃ আব্দুল আলিম।  ।  
একদিন অর্জনপাড়া ঢুকতেই একটি দৃশ্য আমার মন কাড়লো। আমি সম্পাদককে বললাম ভাই একটি বিষয় খেয়াল করেছেন, ভাই বললো না তো, আমি সঙ্গে সঙ্গে মোটরবাইক ঘোরালাম। ঘটনার কাছে হাজির। ভাই ঘটনাটি দেখে আমাকে বললো ছবি ওঠাও। ছবি ওঠাতে গিয়ে যতসব বিপত্তি। প্রথমে যে অকৃত্তিম ভালোবাসা মেকাপ বিহীন সুন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম সেটা আর আসছে না। গ্রামের পরিবেশে আমরা দুই জন ভদ্র লোক টাইপের মানুষ। আমরা দু’জনই গ্রামীণ সরল ভাালোবাসার অন্তরায় হয়ে গেলাম। অনুরোধ করলাম বার বার আপনারা যে অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায় একটু থাকেন আমরা কয়েকটি ছবি নেব। কিছুতেই আর রাজি হয় না। লজ্জা মিশ্রিত নরম গলায় মেয়েটি বললো ছবি কি করবেন। আমাদের বসতে দেয়ার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু আমরা যেটা চাচ্ছি সে ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। প্রথম দেখাতে তাদের ভালোবাসা আমার লোভের কারণ হলো। পরে আমাদের অনুরোধ রাখলো ঠিক, কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে ভালোবাসার যে মানসিক প্রশান্তি, সরল মায়াবী মন, মমতামীয় রূপ লক্ষ্য করেছিলাম সেটা আর পেলাম না। ছবি নিলাম প্রকুৃত ছবি নয়, ছবির জন্য ছবি।  গ্রামীণ পরিবেশের নৈস্বর্গীক সোন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক কবি সাহিত্যিক অনেক কাব্য গাঁথা  রচনা করেছেন। মুগ্ধতার অনেক উপাদান গ্রামে আছে।  নিজ গ্রামের শরৎ এর নীল আকাশ, বিশুদ্ধ বাতাশ, মাটি, গাছপালা, পুকুর, বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয় স্বজন, গ্রামের পরিচিত মানুষজন, কৃষ্টি-কালচার বড়ই আপন  এবং প্রেমোময়। মানুষ নিজগ্রাম ছাড়া পৃথিবীর যে প্রান্তে যত সুখেই থাকুক না কেন মনের অজান্তেই মনের ভেতরে টান লাগে। প্রশান্তির জায়গা বলতে নিজ জন্মভূমির মত আর কোথাও নেই।
বাঙ্গালীর সংস্কৃতির অধিকাংশ উপাদান এবং পেক্ষাপট গ্রামের পরিবেশে বিদ্যমান। নবান্ন উৎসবের সাথে কৃষাণ-কৃষাণীর ঘরে নতুন ধান উঠার উৎসব। এ উৎসব আত্মীয় স্বজনের মধ্যে পিঠা পায়েশ খাওয়ার এক মিলন মেলা। গ্রামীণ পরিবেশে ঋতু ভেদে প্রকৃতির রূপ বৈচিত্রের যে পরিবর্তন তা মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়। কাঁশফুল, সবুজ ধানের ক্ষেত,  পাকা ধানের ক্ষেত, বর্ষায় বর্ষিত বৃষ্টি, চৈত্রের ক্ষরো তাপে ধুধু মাঠ, দুবলা ঘাষে পা ভিজিয়ে লাঙ্গল জোয়াল নিয়ে কৃষকের মাঠে যাওয়া এ তো গ্রামীন পরিবেশের স¦াতন্ত্র রূপ। কৃষাণী মায়ের ধান সিদ্ধ, ধান ভাঙ্গা, যাতায় পিষা  চাউলের আটায় বিভিন্ন পিঠা পুলি, পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ, কেরসিন কুপি জালিয়ে সন্তানের জন্য মায়ের অপেক্ষা, হারিকেন জালিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার রাত জেগে ভালোবাসা মাখা আবেগী চিঠি মুগ্ধতার চরম পরিনতি। পাটি বা শপ বিছিয়ে ভাইবোন মিলেমিশে পড়াশোনার আসর, হাডুডু ডাংগুলি গোল্লাছোট চোরপুলিশ পলানটুক্কা গুলিখেলা লাঠিখেলা এমন কত খেলাই গ্রামীণ পরিবেশের অংশ বিশেষ। পালাগান মাদারের গান পদ্মাপুরান গান যাত্রাপালা মুর্শিদী গান বাউল গান ভাটিয়ালি গান এগুলো গ্রামীণ সংস্কৃতি। যা এখন  আর তেমন চোখে পড়ে না। জোঁসনা রাতে বাড়ির আঙ্গিনায় পাটি বিছিয়ে বড়দের মুখে নানান রূপ কথার গল্প, যেমন ভূতের গল্প রাজা-রাণীর গল্প, রাজপুত্রের গল্প রাক্ষসের গল্প আরো কত কি। যৌথ পরিবারে ভাইবোনের নিবিড় সম্পর্ক, পাড়ার মানুষজনের সাথে মানবিক সম্পর্ক অনেক কিছুতেই মুগ্ধতা ছড়ায়। পৌষমাসে খেজুরের কাঁচা রস ও মুড়ি,খেজুরের গুড়েরর পিঠা পায়েশ, ভাই-বোন দুলাভাই বন্ধুবান্ধব মিলে কি যে আনুষ্ঠানিকতা সেটা এখন যান্ত্রিক পৃথিবীতে স্মৃতিময়।
অবশ্য এখন বাঙ্গালীর কৃষ্টি কালচার  সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য গ্রামের তুলনাই শহর গুলোতেই বেশি পালন করা হয়। পহেলা বৈশাখ নবান্ন উৎসব বসন্ত বরণ শরৎ উৎসব সহ অনেক সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য অনুষ্ঠান আকারে উপস্থাপন করা হয়। প্রকৃত ঘটনা অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চস্থ করা হয় মাত্র কিন্ত প্রকুত সাধ গন্ধ তার মধ্যে পাওয়া কঠিন। পহেলা বৈশাখে ইলিশ পান্তা ধুম চলে। বাশমতি চাউলের পান্তা বেগুন চপ আলুর চপ ইলিশ ভাজা, আলু ভর্তা আরো কত কি। শ্রী বৃদ্ধির জন্য কাঁচা পেয়াজ ও মরিচ। বেচাকেনার  ধুম শহরের হোটেল গুলোতে। গ্রামের মানুষের জীবন গাঁথা শহরের মানুষের উৎসব। গ্রামীণ মানুষের অভাবের সংস্কৃতি শহুরে জীবনে উৎসব ও ফ্যাশান এবং আনন্দর খুরাক জোগায়। গ্রামীণ প্রেমের মুগ্ধতা কেবল গ্রামের পরিবেশে পাওয়া যায় অন্য কোথাও নয়। এখন যান্ত্রিক পৃথিবীতে অনেক কিছু কৃত্তিমতা ভরা, খাবার দাবার থেকে শুরু করে আচার আচরণ প্রেম ভালোবাসা সবকিছুতে কৃত্তিমতার ছাপ। মন খুলে হাঁসিটা এখন বিরল প্রজাতির বিলিন হওয়া কোন বিষয়ের মত। শহরের যান্ত্রিকতায় মানুষ এখন যন্ত্রের মত চলে।
এখন পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা ইলিশ। গ্রামীন মানুষের পান্তা ইলিশ বলতে ঠেকি ছাটা আউশের চালের পান্তা কাঁচা মরিজ-পিঁয়াজ সাথে ইলিশ মাছের জাল করা ঝোল। তাছাড়া মশুরের ডাল ভর্তা,ঝোল,কচুর শাক পান্তা ভাতে বড়ই সুস্বাদু। জোষ্ঠ্য মাসে গাছ পাঁকা আম জাম কাঠাঁল খাওয়া মজার স্মৃতি ও সাধ স্মৃতিময়।বর্ষা মৌসুমে কলা গাছের ভূড় (নৌকা) নিয়ে বিলের তাজা মাছ ধরা। বিলের কৈ মাগুর শিং টেংরা মাছের ঝোল লোভনীয় খাবার।
 পাট পচাঁ গন্ধে সুবাসিত গ্রামীন পরিবেশ। এ গন্ধের মিষ্টতা গ্রামের মানুষ ছাড়া উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এ গন্ধের সাথে জড়িয়ে থাকে যুগ যুগ ধরে গ্রামীন মানুষের জীবন জীবিকা। শ্রমিক শ্রেনীর মানুষের কিছু দিনের জন্য দূর হয় বেকারত্ব। কৃষক শ্রেনীর মানুষের ঘরে আসে সোনালী আঁশ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। বৃষ্টিতে ভিজে কাদা জলে মাছ ধরা গ্রামের দূরন্ত কিশোর কিশোরীর কি যে উন্মাদোনা তা কেবল গ্রামের ছেলে মেয়েরাই জানে।
 গ্রামে ঢুকতে যে দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছি সেটার ছবি নিলাম। স্বামী মাঠ থেকে এসে খেজুর গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। চৈত্র মাস। পাশে হাতপাখা রাখা। বৌ স্বামীর মাথায় চুলকালো করা কালি লাগাছে। তার মুখে যে প্রশান্তি ছাপ আমি দেখেছি তা নিষ্পাপ সরল গ্রামীণ প্রেমেই সম্ভব। গ্রামীণ প্রেমের মুগ্ধতা ভালবাসার প্রকৃত সাধ আমরা কালের বিবর্তনে হারাচিছ। গ্রামের মানুষ মানুষকে ভালবাসে মায়া করে নিঃস্বার্থ উপকার করে তার যে গভিরতা মুগ্ধতা তা তারা জানে না। তারা শুধু জানে ভালবাসতে। অকৃত্তিম ভালবাসাই গ্রামীন চরিত্রের অহংকার গ্রামীন প্রেমের মুগ্ধতার মুর্তপ্রতিক।

* মোঃ আব্দুল আলিম: কবি ও সাংবাদিক, সহ-সম্পাদক, সাপ্তাহিক শহীদ সাগর। 

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top