পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ফেলা বোমার স্মারক
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঈশ্বরদী (পাবনা)। ।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সারা দেশ থেকে বিজয়ের খবর আসছিল। পাবনার ঈশ্বরদীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়ে ব্রিজের একটি স্প্যান ভেঙে ফেলা হয়। সেই বোমার একটি অংশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। পাকশীর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম) কার্যালয়ের সামনে বোমাটি সংরক্ষণ করা আছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা ব্রিজ ভাঙা বোমার খোলসটি দেখতে পাকশী আসেন। বোমার খোলসটি এখন এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের একটি স্মৃতি হয়ে আছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
সেদিন যেভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে বোমা হামলা করা হয়েছিল, তার বর্ণনা করেন ঈশ্বরদীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার (পাবনা এফএফ) কাজী সদরুল হক তাঁর বর্ণনায় জানান, যুদ্ধের শেষের দিকের ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বর ঈশ্বরদীজুড়ে ১০টি অপারেশন ক্যাম্প তখনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। এরই মধ্যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। তারা ওই দিন (১৪ ডিসেম্বর) পালিয়ে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসছিল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য চরসাহাপুরে প্রকৌশলী আব্দুল গফুরের বাড়ির সামনের রাস্তায় অবস্থান নেন। যশোর-কুষ্টিয়া তখন মুক্ত হয়ে গেছে। দলে দলে পাকিস্তানি হানাদাররা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হতে লাগল। ব্রিজে তারা ডিনামাইট (চার্জ) লাগিয়ে বিদ্যুৎ সংযোজন করে রেখেছিল। কারণ অবস্থা বেগতিক দেখলে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। তারা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল বলে মনে হয়েছিল।
পাকশী রেল টানেল ও বাঘইল রেল টানেলের মাঝামাঝি জায়গায় ৩০ জন পাকিস্তানি সেনাকে কাঁচা বেগুন খেতে দেখা যায়। পাকিস্তানি সেনাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়কের ধারে অবস্থান নিয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে পাকিস্তানি সেনারা কর্ণপাত না করে গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালালে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। একপর্যায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে গ্রামের চারপাশ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলেন। বেপরোয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনারা। তারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, কামান ও জিপ নিয়ে পার হতে থাকে। সদরুল হক বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমরা মিত্র বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা চাই। দুপুর ১২টার দিকে পাকশীর আকাশ দিয়ে ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান হার্ডিঞ্জ সেতুর ওপর চক্কর দিতে থাকে। এরপর শুরু হয় বিমান থেকে বোমাবর্ষণ। চার-পাঁচটি বোমা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। বোমার প্রচণ্ড আঘাতে এ সময় ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটির একদিকের অংশ ভেঙে পদ্মা নদীতে পড়ে যায়। আরেকটি স্প্যানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। হঠাৎ বোমার আওয়াজে চমকে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর দলবদ্ধ ও অ্যাম্বুশ ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা পাকশী থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে।’
প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ঘটনার বর্ণনায় বলেন, ‘আমরা তখন বাঘইল গ্রামে পাকশী পেপার মিল ব্যাগাজ ইয়ার্ডের কাছে অবস্থান নিয়েছিলাম। দুপুর ১২টার দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বিমান অনেকক্ষণ আকাশে মহড়া দিচ্ছিল। প্রথমে পরপর তিনটি এবং কিছুক্ষণ পর আরেকটি বিমান থেকে বোমা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ পাওয়া যায়। শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে। শব্দের পর চরের প্রচণ্ড ধুলা ও ধোঁয়া এলাকায় ছড়িয়ে যায়। পরে আমরা গিয়ে দেখি ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের পশ্চিম ভাগের অংশ পানির নিচে পড়ে আছে। সেদিন আরেকটি বোমা ফেলা হয়েছিল পাকশী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ব্রিজের পশ্চিমে বালুচরের মধ্যে। আরেকটি বোমা পড়েছিল রেললাইনের ওপর। বিমান থেকে ফেলা একটি বোমা বালুর ওপর পড়ায় সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বালুর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই বোমার খোলসটি পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।’
কয়েকজন স্থানীয় প্রবীণ জানান, ১৬ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী মুক্ত হলে বিধ্বস্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখা যায় ১২ নম্বর স্প্যানটি একদিকে কাত হয়ে পানিতে পড়ে আছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ–সংযোগের তারগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ ঝুলে আছে। পাকিস্তানি সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংক সে সময় ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানি সেনারা সেটি পার করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে নতুন স্প্যান লাগানো হয়। পাকশীর সাংস্কৃতিক কর্মী মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি বোমার খোলসটি দেখে আসছি। এটি খোলা আকাশের নিচে থাকায় বৃষ্টির পানি ও রোদের কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সংরক্ষণের জন্য একটি ছাউনির মধ্যে বোমার খোলসটি রাখা উচিত।’
পাকশী ডিআরএম অফিসের সামনে নিরাপত্তাবেষ্টনীর ভেতরে বোমার খোলসটি এখনো রাখা আছে। লোহার তৈরি খোলসটির ওজন প্রায় দুই মণ বলে রেলের এক কর্মী জানান। বোমার খোলসটি রং করে সিমেন্টের বেদিতে গাঁথা রয়েছে। এর চারপাশ লোহা দিয়ে ঘেরা। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী বোমার খোলসটি দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থী এখানে আসেন। পাকশী রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত বোমার খোলসটি পরিষ্কার, সংরক্ষণ ও রং করা হয়।
সাম্প্রতিক মন্তব্য