logo
news image

বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা কয়েকটি সিনেমার গল্প

আমাদের দেশের সিনেমা শিল্পের ইতিহাস বেশ গৌরবময়। ৬০ থেকে ৮০’র দশক ছিল বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ। বেশ কিছু অসাধারণ সিনেমা নির্মাণ হয়েছে এ সময়ে, যার কিছু জগৎ বিখ্যাতও হয়েছিল। কিন্তু বাংলা সিনেমার সেই সুদিন আর নেই। মাঝে মাঝে যে ২-১ টি ভালো সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না তা না, কিন্তু বেশিরভাগ সিনেমায় মানের দিক থেকে ভালো না হওয়ায় দর্শকরা হচ্ছেন হল বিমুখ।

এ দেশে (প্রাচীন পূর্ববঙ্গ) প্রথম সিনেমা নির্মিত হয় ১৯২৭ সালে। ঢাকার নবাব পরিবারের এ সিনেমা নির্মাণের পেছনে ব্যাপক অবদান ছিল। ‘সুকুমারি’ নামের সিনেমাটি ছিল স্বল্প দৈর্ঘ্যের নির্বাক ছবি। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক ছবি ছিল ‘দ্যা লাস্ট কিস’। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৩১ সালে।

১৯৫৭ সালে এসে বাংলা ছবির মোড় ঘুরে যায়। তৈরি হয় বাংলাদেশের প্রথম সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’। পরিচালক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান। এরপরের ইতিহাস তো আরো গৌরবময়। একে একে তৈরি হয়েছে বহু কালজয়ী সিনেমা। যদি বাংলাদেশের সেরা সেরা সিনেমার তালিকা করতে যাওয়া হয় তাহলেও এ স্বল্প পরিসরে তা সম্ভব নয়। তারপরও তারই মাঝে কয়েকটি কালজয়ী সিনেমার ইতিহাস, কাহিনী সংক্ষেপ নিয়ে আজ এ আয়োজন। অনেক কালজয়ী সিনেমা সম্বন্ধেই হয়ত আজ বলা সম্ভব হবে না। তা না হয় আরো অন্য দিনগুলোর জন্য তোলা থাকল।

তিতাস একটি নদীর নাম

২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট বাংলাদেশের সেরা ১০ টি সিনেমা নিয়ে দুটি তালিকা প্রকাশ করে। ১ টি ছিল চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে আর অপরটি দর্শকদের মতামতের উপড়। উভয় ক্ষেত্রে তিতাস  একটি নদীর নাম সিনেমাটি ১ম স্থান অধিকার করে।

তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমাটির পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ১৫৯ মিনিটের এই সিনেমাটি। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমাদের দেশে আগমন করে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন তিনি। অদ্বৈত মল্লবর্মনের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর কাহিনী অবলম্বনে এ সিনেমাটি নির্মিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী আর তার আশে পাশের মানুষদের বিশেষ করে জেলেদের জীবন যাত্রায় এ সিনেমার উপজীব্য বিষয়। সিনামাটিতে গোলাম মুস্তাফা, কবরী চৌধুরী, রোজী সামাদ, প্রবীর মিত্র প্রমুখ গুনী শিল্পীরা অভিনয় করেছেন।  সিনেমাটিতে ঋত্বিক ঘটক নিজেও তিলকচাঁদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

এ ছবিতে কি নেই? প্রেম আছে, আছে ভালবাসা। পরিমিত আবেগ, রহস্য আর সুমধুর সঙ্গীত। সবই যেনো পরিমিত পরিমাণে। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন উস্তাদ বাহাদুর খান। বাহাদুর খান টাইটেলের জন্য যে গান তৈরি করেছিলেন তা ঋত্বিক ঘটকের মনে ধরেনি। অবশেষে তিনি আরিচা ঘাটের এক বৃদ্ধের গাওয়া গান দিয়ে টাইটেল মিউজিক তৈরী করেন।

সিনেমাটিতে দেখানো হয় কিশোর নামের এক জেলে পার্শ্ববর্তি এক গ্রামে বেড়াতে গিয়ে বাসন্তী নামের এক মেয়েকে বিয়ে করে। তাদের বাসর রাতে তারা দুজনই একে অপরের সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা অনুভব করছিল। সে রাতেই মেয়েটিকে অপহরণ করা হয়। যখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েটির স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। সে তার নতুন স্বামীকে পুরোপুরি ভুলে যায়। এ ধরনের নাটকীয়তার মধ্য দিয়েই কাহিনী এগিয়ে চলে।

শ্রাবণ মেঘের দিন

শ্রাবণ মেঘের দিন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের তৈরি একটি সিনেমা। ১৯৯৯ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়। সিনেমাটি তারই লেখা শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাস অবলম্বনে রচিত। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, শাওন, মাহফুজ আহমেদ, আনোয়ারা, ডাঃ এজাজ প্রমুখ।

মতি নামের একজনকে গ্রামেরই কুসুম নামের এক মেয়ে মনে মনে ভালবাসে। মতি একজন গায়ক। কুসুমের গলাও বেশ ভালো। ঢাকা থেকে আসা জমিদারের নাতনি ‘শাহানা’কে ভালবেসে ফেলে মতি গায়ক। এদিকে কুসুমেরও বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তারপর কী ঘটে জানতে হলে দেখতে হবে পুরো সিনেমাটিই। এ সিনেমাটি ৬ টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়। এ সিনেমাটিই বহুদিন পর হলবিমুখ বাংলাদেশের দর্শকদের হলে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

মাটির ময়না

মাটির ময়না বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত একটি চলচ্চিত্র। এটি ২০০২ সালে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তি পায়। এ সিনেমার কাহিনী লেখা থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা করেন তারেক মাসুদ। প্রযোজক ছিলেন তারই স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। অভিনয়ে ছিলেন নুরুল ইসলাম বাবুল, রোকেয়া প্রাচী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সিনেমাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের সময়টাতে এক সঙ্কটময় মুহুর্তে তারেক মাসুদের নিজেরই ছোটবেলার মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। চলচ্চিত্রটি প্রথমে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তিতে বহিষ্কারাদেশ উঠে গেলে ১৬ এপ্রিল, ২০৫ সালে সিনেমাটির ভিসিডি এবং ডিভিডি মুক্তি পায়। এ সিনেমাটি বাংলাদেশের ১ম চলচ্চিত্র ছিল যা শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনয়ন লাভ করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে একটি পরিবারের যুদ্ধ এবং ধর্মের কারণে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়ার গল্পের উপড় সিনেমাটি দাঁড়িয়ে আছে। সিনেমার কাহিনী পরিচালকের নিজের ছোটবেলার জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। মাটির ময়নায় প্রথম বাংলাদেশি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র যা কান ফিল্ম ফেস্টিভালের জন্য মনোনীত হয়।

জীবন থেকে নেয়া

১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমার পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের বছরে নির্মিত এ সিনেমার প্রভাব অনেক। তখন বাঙ্গালির স্বাধীনতা আন্দোলন এক চরম আকার ধারণ করেছে। জীবন থেকে নেয়া সিনেমাটিতে জহির রায়হান সে সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক অসাধারণ স্যাটায়ার বা, হাস্যরসের মাধ্যমে রুপক আকারে তুলে ধরেছিলেন।

সিনেমাটিতে একই সাথে পাশাপাশি দুটি কাহিনী এগিয়ে গেছে। এক দিকে ঘরের বাইরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্য দিকে ঘরের ভেতরে গৃহকর্ত্রীর একনায়েকতন্ত্রের ন্যায় অত্যাচার। পরিবারের সদস্যরা না পেরে একরকম বাধ্য হয়েই গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। এক পর্যায়ে গৃহকর্ত্রী পরাজয় মেনে নেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথমবারের মত দেখানো হয় কোন সিনেমাতে।

এ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন খান আতাউর রহমান। এ সিনেমার অন্যতম বিখ্যাত একটি গান ছিল, “এ খাঁচা ভাঙ্গব আমি কেমন করে?”। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এ সিনেমাটিই ছিল জহির রায়হানের শেষ চলচ্চিত্র। সিনেমাটির স্লোগান ছিল-

একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন
একটি চলচ্চিত্র…

তবে এত সহজে সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। সিনেমা মুক্তির আগেই সেন্সরবোর্ডে একবার আটকিয়ে দেয়া হয় সিনেমাটি। পরে জনগণের আন্দোলনের মুখে সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সিনেমাটি মুক্তির প্রথম দিনেই সারাদেশে আলোড়ন পড়ে গেল। ফলে প্রথম দিনেই নিষিদ্ধ হল এর প্রদর্শনী। সব সিনেমা হল থেকে পাকিস্তানী আর্মি সিনেমার রিল জব্দ করে নিয়ে গেল। পরে আরো কিছু বাধা উৎরিয়ে সিনেমাটি আবার প্রদর্শনের অনুমতি পায়। রাও ফরমান আলী জহির রায়হানকে বলেছিলেন, “ছবিটি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখে নেয়া হবে”।

আজ তো শুনলেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসের অমর কিছু সিনেমার কথা। আরো অনেক অনেক সিনেমার কথা তো বাকি রয়ে গেল। সেগুলো না হয় পরবর্তি কোন লেখাতেই জেনে নেবেন!

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top