logo
news image

আমাদের নারী ফুটবল

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।  ।  
পাকিস্তানের গোলরক্ষক আয়েশা নাসিমের মন খুব খারাপ। ৯ আগস্ট মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৫ সাফের প্রথম ফুটবল ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে ১৪-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে হেরেছে পাকিস্তান। থিম্পুর আরিয়া হোটেলের সিঁড়িতে দেখা হতেই আয়েশা বলছিল, ‘সেদিন রাতে আমি মোটেও ঘুমাতে পারিনি।’ এমন দুঃস্বপ্নের রাত নিশ্চয় সারা জীবনের জন্যই ভুলে যেতে চাইবে অ্যাবোটাবাদের এই কিশোরী!
নারী ফুটবলে বাংলাদেশের পথচলা শুরু ২০০৫ সালে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেয়েদের অভিষেক ঘটে। ২০০৩ সালে চালু হয় প্রথম ঘরোয়া নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট। এর প্রায় দুই বছর পর এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই টুর্নামেন্টে। ওই সময়ে মেয়েদের ফুটবলে টেনে আনা দুষ্করই ছিল। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ১১ জন মেয়েকে নিয়ে ২৩ সদস্যের ফুটবল দল গড়ে ফেডারেশন তখন কোরিয়ায় পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ দলকে। মাত্র তিন মাসের অনুশীলন। এরপর ভারতে গিয়ে শুধু চারটি প্রস্তুতি ম্যাচ। এমন অল্প অনুশীলনে কি আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে লড়াই করা যায়? ফলও তাই হলো খুব বাজে। এএফসির ওই টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচে গুয়ামের কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পরের ম্যাচে জাপানের কাছে হারে ২৪-০ গোলে! গ্রুপের শেষ ম্যাচে হংকংয়ের সঙ্গে যদিও লড়াই করে হেরেছিল ২-৩ গোলের ব্যবধানে। অথচ সেই হংকংকেই চলতি বছরের মার্চ মাসে জকি ক্লাব অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল টুর্নামেন্টে ৬-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া, ইরান, হংকং ও বাংলাদেশকে নিয়ে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রতিপক্ষের জালে গোল দিয়েছিল ২৪টি! হয়েছিল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
বাংলাদেশের মেয়েদের এমন বদলে যাওয়ার রহস্য একটাই—দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন। পাশাপাশি বেশি বেশি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া। এমনিতেই বয়সভিত্তিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে কয়েক বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। ২০১৪ সালে নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে শুরু। এরপর তাজিকিস্তানে একই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বেও সেরা। এরপর গত বছর ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের পর মার্চে হংকংয়ে চার জাতি জকি কাপেও হয়েছে চ্যাম্পিয়ন। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ভুটানেও খুব আত্মবিশ্বাসী এই বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের এই উত্থানের সবচেয়ে বড় অবদান বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। একসময় ময়মনসিংহের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরাই বেশি আধিপত্য দেখাত এই টুর্নামেন্টে। বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলে ময়মনসিংহের মেয়েদের এই আধিপত্য এখনো রয়েছে। আনন্দের খবর হচ্ছে, ময়মনসিংহের বাইরে টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, রাঙামাটি, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, ঝালকাঠি, কক্সবাজার, ঝিনাইদহ থেকেও উঠে আসছে মেয়েরা।
আক্রমণে অধিনায়ক মারিয়া মান্দা। ছবি: সংগৃহীতআক্রমণে অধিনায়ক মারিয়া মান্দা। ছবি: সংগৃহীতবঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট ছাড়াও জেএফএ কাপ ও যুব গেমসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সেরা উদীয়মান ও সেরা খেলোয়াড়দের বাছাই করে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্পে সুযোগ দিচ্ছে ফেডারেশন। এরপর মতিঝিলের বাফুফে ভবনের আবাসিক ক্যাম্পে চলছে সারা বছর নিবিড় অনুশীলন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৫ সাফের প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ এরপর মাত্র ১০ দিনের ছুটি পেয়েছিল মেয়েরা! তারপর থেকেই টানা সাত মাস কোচ গোলাম রব্বানীর অধীনে দুই বেলা অনুশীলন করেছে মেয়েরা। এত কষ্ট আর পরিশ্রমের ফল তো মাঠেই পেয়ে যাচ্ছে মারিয়া মান্দারা। কষ্টগুলোকে তাই মোটেও কষ্ট বলে মনে হয় না। থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে অনুশীলন শেষে সবার হয়ে যেন অধিনায়ক মারিয়া মান্দা সেই কথাটাই বলছিল, ‘আমাদের সামনে খেলা থাকলে ছুটি দেন না স্যারেরা। ভালো কিছু করতে হলে কষ্ট তো করতেই হবে। এটা সত্যি, গতবার বড়দিনে ছুটি পাইনি। ঈদেও অনেকে বাড়ি যেতে পারে না। বাড়িতে যেতে পারব না ভেবে প্রথমে একটু মন খারাপ হতো। কিন্তু পরক্ষণই নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম, আমি তো দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। দেশের জন্য কিছু করতে পারলেই নিজের কাছে ভালো লাগে।’
এবারের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নিচ্ছে ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। অন্য দলের চেয়ে বাংলাদেশকে একটু এগিয়েই রাখছেন কোচ গোলাম রব্বানী, ‘এই দলের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, ম্যাচের শুরু থেকে ৯০ মিনিট পর্যন্ত ওরা একই ধারায় খেলতে পারে। এটা আমাদের জন্য বিশাল প্লাস পয়েন্ট। মেয়েদের ফিটনেস ভালো। ট্যাকটিক্যালি ও টেকনিক্যালি ওদের মধ্যে বোঝাপড়া দারুণ।’
গত কয়েক বছরের সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত এই মেয়েরা ভুটান থেকে ট্রফি নিয়েই দেশে ফিরতে চায়।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top