logo
news image

নারীদের ঘরে কাজ বেশি-অফিসে বেতন কম

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।  ।  
আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যটি স্বাভাবিক। স্বামী-স্ত্রী দুজনই সবে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছেন। বাইরের কাপড় ছেড়ে স্বামী হাত-মুখ ধুয়ে দৈনিক পত্রিকা ও টিভির রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে বসে পড়েছেন। অপেক্ষা করছেন চা-নাশতার জন্য। চা-নাশতার জোগান দিতে অবশ্যই স্ত্রীকে ঢুকে পড়তে হয়েছে হেঁসেলে। কাজটি দ্রুত করার জন্য তিনি বাইরের কাপড় ছাড়ারও সময় পাননি। হয়তো চা-নাশতার পর রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে একবারেই ফ্রেশ হয়ে নেবেন। ঘুমে জড়িয়ে যাওয়া চোখ বন্ধ করার আগমুহূর্তে পরদিন সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবারের জন্য কী ব্যবস্থা করবেন, তা অভ্যাসমতো ভেবে নেবেন। সন্তান থাকলে তাদের স্কুল, পড়াশোনার ভাবনা তো আছেই।
যুগের পর যুগ এমন ‘সাদামাটা’ দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত চোখে কোনো অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে না। মনে হয়, এটাই হয়ে আসছে। এটাই হবে। এটাই হওয়া উচিত। চাকরিজীবী কয়েক দম্পতির সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে নাম প্রকাশ করে সংসারে অশান্তিকে ‘আমন্ত্রণ’ জানাতে রাজি নন সেই স্ত্রীরা। একজন স্ত্রী বললেন, ‘অফিস থেকে এসে আমারও তো বিশ্রাম নিতে মন চায়। কিন্তু কোনো দিন দেখলাম না, ও (স্বামী) নিজে থেকে এসে কোনো কাজে হাত লাগিয়েছে। অফিস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে যাই। রান্নাবান্নার কথা, সন্তানদের কথা ভাবতে হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ কদিন আগে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেরা বাসায় সারা দিনে আধা ঘণ্টা কাজ করে। সেখানে একই বয়সী মেয়েরা ৪৫ মিনিট কাজ করেন। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর বেতনও কম। এর কারণ হচ্ছে, বাড়ির কাজের দায়িত্বের বেশির ভাগ নারীর নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া। গবেষকদের মতে, নারী-পুরুষের সমতা চাইলে বেতনভুক্ত কাজের জন্য শুধু মেয়েদের তৈরি করলেই হবে না, একই সঙ্গে ছেলেদের ঘরের কাজের মতো বেতন ছাড়া কাজে যুক্ত হতে শেখাতে হবে।Eprothomalo
ঘরের কাজ মেয়েদের
সমাজে ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাজের পার্থক্যের বিষয়টি খুব স্পষ্ট করে দেওয়ার মানসিকতা দেখা যায় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আলী আহসান। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় মেয়েদের হাতে হাঁড়ি-পাতিল খেলনা তুলে দেওয়া হয়। ছেলেদের হাতে দেওয়া হয় গাড়ি, বল। মেয়েটিকে শেখানো হয় “তোমার কাজ ঘরে”। ছেলেটিকে বোঝানো হয়, “বাইরের পৃথিবী তার”। এমনকি খাবারের ক্ষেত্রে মেয়েশিশুটি বৈষম্যের শিকার হয়। সম্পদ বণ্টনে নারীদের কম দেওয়া হয় পুরুষের চেয়ে।’
এ ধরনের মানসিকতা পরিবার থেকে শুরু হয়ে কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতনকাঠামো এক থাকে বলে সেখানে বৈষম্য সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটা খুব স্পষ্ট হয়। একজন নারীকে আসলে দুটি চাকরি করতে হয়। একটি অফিসে, অন্যটি বাড়িতে। একজন পুরুষের সেই সমস্যা নেই। তিনি অফিসের কাজেই বেশি মনোযোগ দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে অনেক নারী ইচ্ছা করেই পিছিয়ে থাকেন, বাড়িতে সময় বেশি দেন। যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি করেন না।
মার্কিন ওই গবেষণার সহগবেষক যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী সান্ড্রা হোফার্থ বলেছেন, কম বয়সে ঘরের কাজে যুক্ত হলে শিশুদের দক্ষতা বাড়ে। প্রগতিশীল চিন্তার মানুষেরা নিজের ছেলেদেরও ঘরের কাজ করতে শেখান।তবে গবেষণার ফলাফলে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি।
সান্ড্রা হোফার্থ ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৫৮টি উচ্চবিদ্যালয়ের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর তরুণের ওপর এই গবেষণা চালান। গবেষণায় ঘরের কাজ বলতে বোঝানো হয়েছিল, রান্না করা, তৈজসপত্র পরিষ্কার করা, পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া, বাড়িঘর গুছিয়ে রাখা ও গাড়ি ধুয়েমুছে রাখা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, কম শিক্ষিত মা-বাবার মেয়েদের ঘরের কাজ বেশি করতে হয়। সেই তুলনায় কিছুটা বেশি শিক্ষিত মা-বাবার মেয়েরা ঘরের কাজে ২৫ শতাংশ কম কাজ করে। এরপরও তারা ছেলেদের চেয়ে প্রতিদিন ১১ মিনিট বেশি কাজ করে।
ঘরের কাজ মেয়েদের—বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করা হয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ্ দীবা। তিনি বলেন, ‘জেন্ডার ধারণায় কাজের সংজ্ঞা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যে এটা মেয়েদের কাজ, ওটা ছেলেদের কাজ। পরিবারে এই চর্চা বহু বছর ধরে চলে আসছে। অনেক পরিবার এটাকে পরম্পরা নাম দিয়ে “আমাদের বাড়ির মেয়েরা বাইরে কাজ করে না, ঘরে থাকে” বলতে গর্ব বোধ করে। পুরুষতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতায় মেয়েদের পিছিয়ে রাখা হয়।
অফিসে পিছিয়ে থাকা, বেতনবৈষম্য
লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্যের অভিযোগও পুরোনো। এই চিত্র যেন সারা বিশ্বেই। একই দায়িত্ব পালন করেও পুরুষের চেয়ে নারীরা বেতন কম পান। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) চীন সম্পাদক কেরি গ্রেসি বেতনবৈষম্যের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করার পর বিষয়টি যেন চোখে আঙুল দিয়ে আবারও জানান দেয়।
গত বছরের জুলাই মাসে কর্মীদের চাপের মুখে বিবিসি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ বেতনভোগী সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, বেশি বেতন পাওয়া ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনই পুরুষ।
অল্প কিছু উপাত্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঘরের কাজে নারী-পুরুষের ব্যবধান কমে আসছে। পরিবর্তনটা ছেলেদের দিক দিয়েই আসছে।
ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়! নরওয়েতে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই ঘরের কাজে বেশি সময় দেয়। বাংলাদেশেও এমন অনেক পুরুষ আছেন, যাঁরা মা বা বোন বা স্ত্রীর সঙ্গে সমানতালে ঘরের কাজ করতে ‘লজ্জাবোধ’ করেন না।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top